ঢাকা ০৮:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ১৮ প্রকল্প অনুমোদন Logo দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প  গ্যাস পাওয়ার অপেক্ষা ফুরাচ্ছে না দুই বছরেও Logo আটঘরিয়া জ্যামীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ মিছিল, প্রশাসনে স্মারকলিপি প্রদান Logo দৈনিক বার্তার অনলাইন ও মাল্টিমিডিয়ার প্রকাশনার সফলতা কামনা করলেন রোকেয়া রাজ্জাক জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সিদ্দিকুর রহমান হাওলাদার Logo পাবনা-৩ আসনে বিএনপির জনসমুদ্রে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবী Logo স্কয়ার ফার্মারর বিরুদ্ধে ডোজ প্রতারণা ও রিপ্যাকিংয়ের অভিযোগে প্রেস কনফারেন্স শনিবার Logo ৫৭ বছরেও শেবাচিমে চালু হয়নি নিউরো ওয়ার্ড, স্ট্রোকের রোগীদের চরম ভোগান্তি Logo সৈয়দপুরে আর্মি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক হিসাববিজ্ঞান দিবস পালিত Logo তানোরে নতুন ধানের জাত ব্রি ধান ১০৩ এর মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত Logo প্রিপেইড মিটার স্থাপন বন্ধ ও মামলা প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন দাবিতে মৌন মিছিল ও স্মারকলিপি হস্তান্তর

আইএইএর প্রতিবেদনে নিরাপত্তা নিয়ে উৎকন্ঠা, আবারো রূপপুর থেকে বিদ্যুৎ পেতে অপেক্ষা বাড়লো

বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুড়ান্ত ধাপে রয়েছে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। দীর্ঘ এক দশক ধরে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পরমাণু সংস্থা রোসাটমের তত্তাবধানে অবকাঠামো নির্মান শেষে এখন চলছে পরমাণু জ্বালানি ইউরেনিয়াম লোডের প্রস্তুতি। তবে, চুড়ান্ত এই পর্যায়ে একের পর এক নেতিবাচক খবরে প্রকল্পটি নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ, প্রকল্প এলাকার আশেপাশে জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। তবে,প্রকল্পের নিরপত্তা ও আন্তর্জাতিক আনবিক সংস্থার (আইএইএ) প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা পরিকল্পিতভাবে বিকৃত করে উপস্থাপন করে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে বলে দাবি রূপপুর প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। আইএইএর অনুমোদন ছাড়া, নিরপত্তার শর্ত পূরণ না করে যেনতেনো ভাবে উৎপাদনে যাওয়ার কোনই সুযোগ নেই বলেও জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) কোনো নির্দিষ্ট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত Pre-OSART ev OSART মিশনের গোপনীয় প্রতিবেদন প্রদান করে না। সংস্থাটি কোন মিশনের প্রতিবেদন চূড়ান্তকরণের পর তা সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করে থাকে। পারমাণবিক ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার কেন্দ্রীয় ইন্টার-গভ:মেন্টাল ফোরাম  হিসেবে আইএইএ-এর আইনগত লক্ষ্য হলো “বিশ্বব্যাপী শান্তি, স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির জন্য পারমাণবিক শক্তির অবদানকে ত্বরান্বিত ও বিস্তৃত করা।” একইসাথে এর সামরিক ব্যবহার প্রতিরোধ নিশ্চিত করা। সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সংস্থাটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রদত্ত নানাবিধ পরামর্শমূলক ও পিয়ার রিভিউ (Peer Review) সেবা প্রদান করে, যা জাতীয় পর্যায়ে পারমাণবিক অবকাঠামো ও নিরাপত্তা অনুশীলনকে প্রতিষ্ঠিত ও সুদৃঢ় করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, আইএইএ এর একটি বিশেষজ্ঞ দল গত ১০-২৭ আগস্ট রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রি-ওসার্ট মিশন পরিচালনা করে। এরপর সংস্থাটি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রেসনোট প্রকাশ করে তাদের সফর ও পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে ধারণা দেয়। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিয়ে সতর্কবার্তা ও নির্দেশনা জানানো হয়েছে। এ প্রতিনিধি দল তিনমাসের মধ্যে রূপপুর প্রকল্প নিয়ে পর্যবেক্ষণের চুড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। প্রতিবেদনের সুপারিশ ও শর্তসমূহ পূরণের পরই অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে পরমানু চুল্লীতে জ্বালানি লোডিং সম্ভব হবে। এর আগে কোনভাবেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর সুযোগ নেই। ফলে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের প্রথম ইউনিটে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরুর কথা থাকলেও তা হচ্ছেনা।

এদিকে, আইএইএর গোপন প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে ‘নিরপত্তা নিশ্চিত না করেই তড়িঘড়ি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর চেষ্টা  এবং এর প্রেক্ষিতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশংকা প্রকাশ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণায় প্রকল্প এলাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক প্রচারণাকে অপপ্রচার ও ভুল তথ্য সম্বলিত জানিয়ে রূপপুর প্রকল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পরিকল্পিত চক্রান্ত বলে দাবি করেছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রি-অপারেশনাল সেফটি রিভিউ টিম (প্রি-ওসার্ট) বেশ কিছু অসংগতি তুলে ধরে নানা সুপারিশ ও পরামর্শ সংবলিত একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশকে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতামত পাওয়ার তিন মাস পর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে আইএইএ। এরপর চূড়ান্ত ওসার্ট মিশন পাঠাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। সবকিছু ঠিক থাকলে কেন্দ্রটি তখন পারমাণবিক জ্বালানি লোডিংয়ের জন্য প্রস্তুত হবে। পুরো প্রক্রিয়া এ বছরে শেষ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন একাধিক কর্মকর্তা। তাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনে যাওয়া আবারো পিছিয়ে যাচ্ছে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জরুরি পরীক্ষাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এক. নন নিউক্লিয়ার টেস্ট, যেটি করা হয় ফুয়েল লোডিংয়ের আগে এবং দুই. নিউক্লিয়ার টেস্ট, যা করা হয় ফুয়েল লোডিংয়ের পরে। রূপপুরে প্রায় ১ হাজার ৭০০টি নন নিউক্লিয়ার টেস্ট করা দরকার। করা হয়েছে ৭৫০টির মতো। প্রকল্পটিতে কারিগরি সমাধান বা বিকল্প উপায়ের নামে এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার ‘টেকনিক্যাল সলিউশন’ দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য প্রায় ২৪.৫ মেগাপ্যাসকেল চাপে হাইড্রোস্ট্যাটিক টেস্ট করা হয়। পরীক্ষার আগে সার্কিটের সব যন্ত্রাংশ সঠিকভাবে স্থাপন বাধ্যতামূলক। রূপপুরে সেইফটি ভালভ না বসিয়েই পরীক্ষা করার অভিযোগ রয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রে তেজস্ক্রীয় বিকিরণ প্রতিরোধক তার ব্যবহার করার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকল্পের মূল ডিজাইনে বৈদ্যুতিক তারের একটি নির্দিষ্ট মান ঠিক করা থাকে। নিয়ম অনুযায়ী সেটিই দিতে হবে। কোনো কারণে না পাওয়া গেলে ডিজাইনারকে জানাতে হবে। রূপপুর প্রকল্পে অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না।’ ‘রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ অন্তত ৬০ বছর। এটা বিবেচনা করেই যন্ত্রপাতি ও উপকরণ স্থাপন করতে হবে যাতে কোনো সমস্যা তৈরি না হয়। রূপপুরের সরঞ্জাম ও উপকরণাদি বিশেষভাবে তৈরি। কিন্তু সেখানে নকশাবহির্ভূত এমনকি স্থানীয়ভাবে তৈরি নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। কখনো দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ধার করে প্রথম ইউনিটে বসিয়ে অস্থায়ীভাবে পরীক্ষার কাজ করা হয়েছে। সমস্যা সবচেয়ে বেশি রয়েছে বৈদ্যুতিক কেবল, ভালভ, পাম্প এবং কন্ট্রোল সিস্টেমের ক্ষেত্রে, যা কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বড় ভূমিকা রাখে। প্রকল্পটিতে জরুরি অবস্থায় ১০.৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ডিজেল জেনারেটর ব্যবহার করার কথা, কিন্তু মূল ডিজাইনের বাইরে গিয়ে অস্থায়ীভাবে স্থানীয় বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা হয়েছে। মেকানিক্যাল ড্রাফট কুলিং টাওয়ারের ফ্যানগুলোতেও ব্যবহার করা হয়েছে এসব বৈদ্যুতিক তার। এগুলোর মান ও স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এসব বিষয়ে আপত্তি দিয়েছে আইএইএর পর্যবেক্ষক দল। তাদের চুড়ান্ত পর্যবেক্ষণের আগে এসব ত্রুটি দূর করতে বলা হয়েছে। প্রাথমিক জ্বালানি লোডিংয়ের আগে গত মাস পর্যন্ত ১২টি টেকনিক্যাল সমাধান পর্যালোচনাধীন ছিল। যে সেফটি সিস্টেমগুলো চালু হওয়ার কথা, সেগুলোর পরীক্ষাও করা হয়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা এখনো বাকি। এছাড়া প্রকল্পের অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা,কাজের ধারাবাহিকতা না রাখা, নির্মাণ কাজে অসংগতি ও ইমারজেন্সি রেসপন্সসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে দুর্বলতার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আইএইএ।
আইএইএর সুপারিশমালা ও সতর্ক নির্দেশনাকে স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন রূপপুর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ  বলছেন, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা কোনো নির্দিষ্ট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে গোপনীয় প্রতিবেদন দেয় না। সংস্থাটি কোন মিশনের প্রতিবেদন চূড়ান্তকরণের পর তা সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করে থাকে। পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত ও সামরিক ব্যবহার প্রতিরোধে অঙ্গীকার করা সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সংস্থাটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরামর্শমূলক সেবা প্রদান করে। সে ধারাবাহিকতায় আইএইএ রূপপুর প্রকল্পের যে ১৭টি বিষয় চিহ্নিত করে পর্যবেক্ষণ সুপারিশ দিয়েছে তা প্রকল্পের আন্তর্জাতিক মান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই্ কঠোর সুপারিশমালা বাস্তবায়নের নির্দেশনাই প্রমাণ করে নিরপত্তায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি রেখে প্রকল্প চালুর সুযোগ নেই।

নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক প্রকল্প পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র যাতে শতভাগ নিরাপদ হয়, সেজন্য পরামর্শ নিতেই আইএইএ’র প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পরামর্শ মোতাবেক যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে এবং কমিশনের অনুমোদন পেলে জ্বালানি লোড করা হবে। তার আগে এ কেন্দ্র পরিচালনা করা হবে না। প্রি-ওসার্ট মিশনের পর ফাইনাল ওসার্ট মিশন হবে। সুতরাং প্রি-ওসার্ট মিশনের পর্যবেক্ষণ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।’

তিনি আরো বলেন ‘বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এমন কিছু পরীক্ষা রয়েছে, যেগুলো দুই-তিন ঘণ্টা লাগে। ফলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আর প্রি-ওসার্ট মিশনের পর্যবেণগুলো পর্যায়ক্রমে সমাধান করা হবে। তাছাড়া অন্য দেশের প্রি-ওসার্ট মিশনের প্রতিবেদনের চেয়ে বাংলাদেশের জন্য যে প্রতিবেদন আইএইএ দিয়েছে, তা অনেক ভালো’ বলে যোগ করেন তিনি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ১৮ প্রকল্প অনুমোদন

আইএইএর প্রতিবেদনে নিরাপত্তা নিয়ে উৎকন্ঠা, আবারো রূপপুর থেকে বিদ্যুৎ পেতে অপেক্ষা বাড়লো

Update Time : ০৯:২৮:৫৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুড়ান্ত ধাপে রয়েছে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। দীর্ঘ এক দশক ধরে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পরমাণু সংস্থা রোসাটমের তত্তাবধানে অবকাঠামো নির্মান শেষে এখন চলছে পরমাণু জ্বালানি ইউরেনিয়াম লোডের প্রস্তুতি। তবে, চুড়ান্ত এই পর্যায়ে একের পর এক নেতিবাচক খবরে প্রকল্পটি নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ, প্রকল্প এলাকার আশেপাশে জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। তবে,প্রকল্পের নিরপত্তা ও আন্তর্জাতিক আনবিক সংস্থার (আইএইএ) প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা পরিকল্পিতভাবে বিকৃত করে উপস্থাপন করে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে বলে দাবি রূপপুর প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। আইএইএর অনুমোদন ছাড়া, নিরপত্তার শর্ত পূরণ না করে যেনতেনো ভাবে উৎপাদনে যাওয়ার কোনই সুযোগ নেই বলেও জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) কোনো নির্দিষ্ট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত Pre-OSART ev OSART মিশনের গোপনীয় প্রতিবেদন প্রদান করে না। সংস্থাটি কোন মিশনের প্রতিবেদন চূড়ান্তকরণের পর তা সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করে থাকে। পারমাণবিক ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার কেন্দ্রীয় ইন্টার-গভ:মেন্টাল ফোরাম  হিসেবে আইএইএ-এর আইনগত লক্ষ্য হলো “বিশ্বব্যাপী শান্তি, স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির জন্য পারমাণবিক শক্তির অবদানকে ত্বরান্বিত ও বিস্তৃত করা।” একইসাথে এর সামরিক ব্যবহার প্রতিরোধ নিশ্চিত করা। সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সংস্থাটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রদত্ত নানাবিধ পরামর্শমূলক ও পিয়ার রিভিউ (Peer Review) সেবা প্রদান করে, যা জাতীয় পর্যায়ে পারমাণবিক অবকাঠামো ও নিরাপত্তা অনুশীলনকে প্রতিষ্ঠিত ও সুদৃঢ় করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, আইএইএ এর একটি বিশেষজ্ঞ দল গত ১০-২৭ আগস্ট রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রি-ওসার্ট মিশন পরিচালনা করে। এরপর সংস্থাটি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রেসনোট প্রকাশ করে তাদের সফর ও পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে ধারণা দেয়। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিয়ে সতর্কবার্তা ও নির্দেশনা জানানো হয়েছে। এ প্রতিনিধি দল তিনমাসের মধ্যে রূপপুর প্রকল্প নিয়ে পর্যবেক্ষণের চুড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। প্রতিবেদনের সুপারিশ ও শর্তসমূহ পূরণের পরই অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে পরমানু চুল্লীতে জ্বালানি লোডিং সম্ভব হবে। এর আগে কোনভাবেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর সুযোগ নেই। ফলে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের প্রথম ইউনিটে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরুর কথা থাকলেও তা হচ্ছেনা।

এদিকে, আইএইএর গোপন প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে ‘নিরপত্তা নিশ্চিত না করেই তড়িঘড়ি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর চেষ্টা  এবং এর প্রেক্ষিতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশংকা প্রকাশ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণায় প্রকল্প এলাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক প্রচারণাকে অপপ্রচার ও ভুল তথ্য সম্বলিত জানিয়ে রূপপুর প্রকল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পরিকল্পিত চক্রান্ত বলে দাবি করেছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রি-অপারেশনাল সেফটি রিভিউ টিম (প্রি-ওসার্ট) বেশ কিছু অসংগতি তুলে ধরে নানা সুপারিশ ও পরামর্শ সংবলিত একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশকে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতামত পাওয়ার তিন মাস পর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে আইএইএ। এরপর চূড়ান্ত ওসার্ট মিশন পাঠাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। সবকিছু ঠিক থাকলে কেন্দ্রটি তখন পারমাণবিক জ্বালানি লোডিংয়ের জন্য প্রস্তুত হবে। পুরো প্রক্রিয়া এ বছরে শেষ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন একাধিক কর্মকর্তা। তাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনে যাওয়া আবারো পিছিয়ে যাচ্ছে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জরুরি পরীক্ষাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এক. নন নিউক্লিয়ার টেস্ট, যেটি করা হয় ফুয়েল লোডিংয়ের আগে এবং দুই. নিউক্লিয়ার টেস্ট, যা করা হয় ফুয়েল লোডিংয়ের পরে। রূপপুরে প্রায় ১ হাজার ৭০০টি নন নিউক্লিয়ার টেস্ট করা দরকার। করা হয়েছে ৭৫০টির মতো। প্রকল্পটিতে কারিগরি সমাধান বা বিকল্প উপায়ের নামে এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার ‘টেকনিক্যাল সলিউশন’ দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য প্রায় ২৪.৫ মেগাপ্যাসকেল চাপে হাইড্রোস্ট্যাটিক টেস্ট করা হয়। পরীক্ষার আগে সার্কিটের সব যন্ত্রাংশ সঠিকভাবে স্থাপন বাধ্যতামূলক। রূপপুরে সেইফটি ভালভ না বসিয়েই পরীক্ষা করার অভিযোগ রয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রে তেজস্ক্রীয় বিকিরণ প্রতিরোধক তার ব্যবহার করার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকল্পের মূল ডিজাইনে বৈদ্যুতিক তারের একটি নির্দিষ্ট মান ঠিক করা থাকে। নিয়ম অনুযায়ী সেটিই দিতে হবে। কোনো কারণে না পাওয়া গেলে ডিজাইনারকে জানাতে হবে। রূপপুর প্রকল্পে অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না।’ ‘রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ অন্তত ৬০ বছর। এটা বিবেচনা করেই যন্ত্রপাতি ও উপকরণ স্থাপন করতে হবে যাতে কোনো সমস্যা তৈরি না হয়। রূপপুরের সরঞ্জাম ও উপকরণাদি বিশেষভাবে তৈরি। কিন্তু সেখানে নকশাবহির্ভূত এমনকি স্থানীয়ভাবে তৈরি নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। কখনো দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ধার করে প্রথম ইউনিটে বসিয়ে অস্থায়ীভাবে পরীক্ষার কাজ করা হয়েছে। সমস্যা সবচেয়ে বেশি রয়েছে বৈদ্যুতিক কেবল, ভালভ, পাম্প এবং কন্ট্রোল সিস্টেমের ক্ষেত্রে, যা কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বড় ভূমিকা রাখে। প্রকল্পটিতে জরুরি অবস্থায় ১০.৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ডিজেল জেনারেটর ব্যবহার করার কথা, কিন্তু মূল ডিজাইনের বাইরে গিয়ে অস্থায়ীভাবে স্থানীয় বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা হয়েছে। মেকানিক্যাল ড্রাফট কুলিং টাওয়ারের ফ্যানগুলোতেও ব্যবহার করা হয়েছে এসব বৈদ্যুতিক তার। এগুলোর মান ও স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এসব বিষয়ে আপত্তি দিয়েছে আইএইএর পর্যবেক্ষক দল। তাদের চুড়ান্ত পর্যবেক্ষণের আগে এসব ত্রুটি দূর করতে বলা হয়েছে। প্রাথমিক জ্বালানি লোডিংয়ের আগে গত মাস পর্যন্ত ১২টি টেকনিক্যাল সমাধান পর্যালোচনাধীন ছিল। যে সেফটি সিস্টেমগুলো চালু হওয়ার কথা, সেগুলোর পরীক্ষাও করা হয়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা এখনো বাকি। এছাড়া প্রকল্পের অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা,কাজের ধারাবাহিকতা না রাখা, নির্মাণ কাজে অসংগতি ও ইমারজেন্সি রেসপন্সসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে দুর্বলতার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আইএইএ।
আইএইএর সুপারিশমালা ও সতর্ক নির্দেশনাকে স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন রূপপুর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ  বলছেন, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা কোনো নির্দিষ্ট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে গোপনীয় প্রতিবেদন দেয় না। সংস্থাটি কোন মিশনের প্রতিবেদন চূড়ান্তকরণের পর তা সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করে থাকে। পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত ও সামরিক ব্যবহার প্রতিরোধে অঙ্গীকার করা সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সংস্থাটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরামর্শমূলক সেবা প্রদান করে। সে ধারাবাহিকতায় আইএইএ রূপপুর প্রকল্পের যে ১৭টি বিষয় চিহ্নিত করে পর্যবেক্ষণ সুপারিশ দিয়েছে তা প্রকল্পের আন্তর্জাতিক মান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই্ কঠোর সুপারিশমালা বাস্তবায়নের নির্দেশনাই প্রমাণ করে নিরপত্তায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি রেখে প্রকল্প চালুর সুযোগ নেই।

নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক প্রকল্প পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র যাতে শতভাগ নিরাপদ হয়, সেজন্য পরামর্শ নিতেই আইএইএ’র প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পরামর্শ মোতাবেক যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে এবং কমিশনের অনুমোদন পেলে জ্বালানি লোড করা হবে। তার আগে এ কেন্দ্র পরিচালনা করা হবে না। প্রি-ওসার্ট মিশনের পর ফাইনাল ওসার্ট মিশন হবে। সুতরাং প্রি-ওসার্ট মিশনের পর্যবেক্ষণ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।’

তিনি আরো বলেন ‘বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এমন কিছু পরীক্ষা রয়েছে, যেগুলো দুই-তিন ঘণ্টা লাগে। ফলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আর প্রি-ওসার্ট মিশনের পর্যবেণগুলো পর্যায়ক্রমে সমাধান করা হবে। তাছাড়া অন্য দেশের প্রি-ওসার্ট মিশনের প্রতিবেদনের চেয়ে বাংলাদেশের জন্য যে প্রতিবেদন আইএইএ দিয়েছে, তা অনেক ভালো’ বলে যোগ করেন তিনি।