
নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সামসুল হকের নানান অপকর্মের প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করেছে শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধন থেকে দ্রুত বিষয়টি তদন্ত করে অধ্যক্ষের শাস্তির দাবি করেছে তারা। এব্যাপারে অধ্যক্ষের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টা থেকে কলেজের মূল ফটকের সামনে এ মানববন্ধন ঘন্টাকাল ব্যাপি চলে। ‘নওগাঁ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ এবং ‘নওগাঁ জুলাই যোদ্ধা সংসদ শহীদদের পরিবার’ এই দুই সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত এ মানববন্ধনে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এরআগে তারা কলেজের গেটে কয়েকজন ছাত্রীর ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে অধ্যক্ষের দেয়া নানান আপত্তিকর মন্তব্যের স্ক্রিনশট সম্বলিত ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়।
‘নওগাঁ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ তাদের ব্যানারে কলেজে অনিয়ম, দূর্নীতি, নারী শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের আপত্তিকর কথোপকথন ও কলেজ প্রশাসন কর্তৃক হামলার প্রতিবাদে এবং ‘নওগাঁ জুলাই যোদ্ধা সংসদ শহীদদের পরিবার’ তাদের ব্যানারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত জুলাই যোদ্ধা জুনায়েদ হোসেনের উপর নওগাঁ সরকারি কলেজ প্রশাসন ও কর্মচারিদের হামলার প্রতিবাদে এ মানববন্ধনের আয়োজন করেছে বলে উল্লেখ করে।
মানববন্ধন চলাকালে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন, শহীদ ফাহমিনের মা কাজী লুলুন মাখমিম শিল্পী, শিক্ষার্থীর বাবা গোলাম রসুল, হামলার শিকার কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জুনায়েদ হোসেন জুন, জেলা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি মিজানুর রহমান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র প্রতিনিধি আরমান হোসেন, শিক্ষার্থী সাদনান সাকিবসহ অন্যরা।
বক্তারা অভিযোগ করেন যে, অধ্যক্ষ প্রফেসর সামসুল হক কলেজের ছাত্রীদের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে আপত্তিকর মেসেজ পাঠানো, অবৈধ সম্পর্কে জড়াতে চাপ প্রয়োগ, কথা না শুনলে নানান হুমকি দেন। তার আপত্তিকর কথোপকথনের স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তারা বলেন, গত সপ্তাহে ৭ সেপ্টেম্বর সকালে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত ফি নেওয়ার প্রতিবাদ করায় কলেজের মাইকে ঘোষণা দিয়ে কর্মচারিরা কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জুনায়েদ হোসেন জুনের ওপর হামলা চালায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে কলেজের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতাকর্মীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র প্রতিনিধি আরমান হোসেন বলেন, ‘‘একজন অধ্যক্ষ হয়ে কিভাবে তিনি ছাত্রীদের সাথে কুরুচিপূর্ন মন্তব্য করতে পারেন। এমন অধ্যক্ষের কাছে কিভাবে ছাত্রীরা নিরাপদ হতে পারে। কলেজে ছাত্রদের জন্য আবাসিক হল ও ক্যান্টিনের ব্যবস্থা নাই। কেন শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে যায়না, কলেজে আসে না সে বিষয় নিয়ে তিনি কখনো ভাবেননি।’’
জেলা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘কলেজের উন্নয়নের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জোর পূর্বক অতিরিক্ত ফি নেয়া হয়। কলেজের কি উন্নয়ন হচ্ছে যার কোন দৃশ্যমান নাই। অধ্যক্ষ কলেজে মাস্তান বাহিনী পুষে রেখেছেন। প্রায়ই কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটছে। দিনের পর দিন কোন শিক্ষার্থী ভয়ে প্রতিবাদের সাহস পায়না।’’
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া স্ক্রিনশটগুলোর একটিতে দেখা যায়, অধ্যক্ষ সামসুল হক একজন ছাত্রীর সৌন্দর্যের প্রশংসা করছেন ‘আরও সুন্দরী ছবি আছে তোমার’। ‘আর নেই স্যার। আমি সুন্দর না। আমার যা মনে হয়’। ‘আছে আছে, ওড়না ছাড়া’। ‘নেই স্যার, স্যরি স্যার’। ‘কলেজে দেখেছি তো’। ‘না স্যার। স্যরি। নেই স্যার। মাফ করবেন’। ‘ওকে, সামনেই দেখবো। অনেক অনেক অনেক ভালো থেকো। বাই’।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ওই শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘মেসেঞ্জারের এই কথোপকথন দুই বছর আগের। এসময় বিএমসি মহিলা কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন সামসুল হক স্যার। সেখানে একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় কলেজে যাতায়াতের সময় প্রায়ই উনি (অধ্যক্ষ) আমার সঙ্গে কথা বলতেন। একদিন আমার সঙ্গে ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় যুক্ত হন। ফেসবুকে কোনো ছবি স্টোরি দিলে অশ্লীল মন্তব্য করতেন। একপর্যায়ে উনি আমার কাছ থেকে ওড়না ছাড়া ছবি চান। স্ক্রিনশট রেখে ওই মুহূর্তে তাকে ব্লক করে দিই। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের পর বিএমসি কলেজ থেকে নওগাঁ সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি হয়ে আসেন সামসুল হক। ২০২৪-২৫ সেশনে এখানে ভর্তি হতে হয়েছে আমাকেও। তাই শতচেষ্টা করেও ভয়ে এতদিন নীরব ছিলাম। হঠাৎ ফেসবুকে সামসুল স্যারের সঙ্গে কয়েকজন ছাত্রীর স্ক্রিনশট ভাইরাল হতে দেখে আমিও প্রতিবাদ জানালাম। উনি (অধ্যক্ষ) অনেক ছাত্রীর সঙ্গে এমন অন্যায় করেছেন।’’
ভাইরাল হওয়া আরেক স্ক্রিনশটে দেখা যায়, দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীর ফেসবুকের স্টোরিতে শেয়ার করা ছবিতে ‘অতীব চমৎকার’ লিখে প্রশংসা করেছেন অধ্যক্ষ সামসুল হক। গত ৩১ মার্চে মেসেঞ্জারের নোটে ওই শিক্ষার্থী লেখেন, ‘কিছু মানুষের সাথে দূরত্ব হওয়া ভীষণ দরকার’। ওই নোটের রিপ্লাই দেন সামসুল ‘আমি কি তার মধ্যে?’
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘‘কলেজে নাচের ইভেন্টে অংশগ্রহণ করার পর একদিন প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান। রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার পর মাঝেমধ্যেই স্যার আমাকে মেসেজ পাঠাতেন। এরপর কোথাও দেখা হলেই উনি (অধ্যক্ষ) আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে সৌন্দর্যের প্রশংসা করতেন। তার কথাবার্তাসহ তাকানোর ধরন পুরোটাই অশ্লীল।’
আরেকটি স্ক্রিনশটে দেখা যায়, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টায় এক ছাত্রীর প্রতি আক্ষেপ প্রকাশ করে অধ্যক্ষ সামসুল হক বলেন, ‘নতুন বউ সাজে দেখা করলে না?’। উত্তরে ছাত্রী বলেন, ‘স্যার ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। স্টল থেকে বের হওয়ার সময় পাইনি। আজকে আমাদের স্টলে সবচাইতে বেশি সেল হইছে’। ‘আমি তোমার বিউটি (সৌন্দর্য) থেকে বঞ্চিত হলাম’। ‘কেন স্যার? দেখা হইছিল তো আপনার সঙ্গে। তবে আপনাকে অনেক অনেক থ্যাংক ইউ স্যার। এত সুন্দর একটা আয়োজন করার জন্য। আমরা অনেক এনজয় করেছি’। ‘আমাকে দেখা দিলে আমিও করতাম’। ‘স্যরি স্যার, আজকে খুবই ব্যস্ত সময় কেটেছে’। ‘কবে দেখা দিবে ওই একই সাজে?’
নওগাঁ সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের ওই শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের বলেন, ‘অধ্যক্ষ সামসুল স্যার প্রায়ই আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করার আবদার করতেন। এসব কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। একপর্যায়ে বিষয়টি বুঝতে পারলে হঠাৎই তিনি একদিন আমাকে কলেজের রোভারসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বের করে দেন। শুধু তাই নয়, আমাকে কলেজ থেকে টিসি দিয়ে বের করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে কয়েকজন সাংবাদিক নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সামসুল হকের ব্যবহৃত মোবাইলফোন নম্বরে একাধিকবার কল দিরেও তিনি রিসিভ করেননি। তার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে সাংবাদিক পরিচয়ে মেসেজ পাঠালেও প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
নওগাঁ প্রতিবেদক 


















