ঢাকা ১২:০৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo দৈনিক বার্তার অনলাইন ও মাল্টিমিডিয়ার প্রকাশনার সফলতা কামনা করলেন রোকেয়া রাজ্জাক জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সিদ্দিকুর রহমান হাওলাদার Logo পাবনা-৩ আসনে বিএনপির জনসমুদ্রে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবী Logo স্কয়ার ফার্মারর বিরুদ্ধে ডোজ প্রতারণা ও রিপ্যাকিংয়ের অভিযোগে প্রেস কনফারেন্স শনিবার Logo ৫৭ বছরেও শেবাচিমে চালু হয়নি নিউরো ওয়ার্ড, স্ট্রোকের রোগীদের চরম ভোগান্তি Logo সৈয়দপুরে আর্মি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক হিসাববিজ্ঞান দিবস পালিত Logo তানোরে নতুন ধানের জাত ব্রি ধান ১০৩ এর মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত Logo প্রিপেইড মিটার স্থাপন বন্ধ ও মামলা প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন দাবিতে মৌন মিছিল ও স্মারকলিপি হস্তান্তর Logo সৈয়দপুরে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার Logo শ্রীমঙ্গলে সাংবাদিকদের সাথে সংসদ সদস্য প্রার্থী হারুনুর রশিদের মতবিনিময় সভা Logo মোবাইল-ই কাল হলো নবম শ্রেণীর ছাত্রী জ্যামির, শিক্ষকের শাসন -অতঃপর বিষপানের মৃত্যু

যেভাবে পুশ ইন করছে বিএসএফ

সীমান্তে বিএসএফের পাহারা,

“বিএসএফ আমাদের বলেছে যে আমরা দুটো গুলি মারবো। গুলি মারার পরে তোমরা সব দৌড় মারবা। তো ওরা দুটো গুলি মারে। তখন আমরা সবাই ভেগে দৌড় মারি। সামনে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়ি।”

কথাগুলো বলছিলেন জাহানারা খাতুন। গত শনিবার ভোরে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও সীমান্তের ভেতরে তাকে আটক করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।

তার সঙ্গে সেদিন ১৭ জনকে আটক করে বিজিবি, যাদের প্রত্যেককেই ভারত থেকে পুশ ইন করা হয়েছিলো বলে বিজিবি পরে জানায়।

জাহানারা খাতুন বলছিলেন, ভারত থেকে ঠেলে বাংলাদেশে ঢোকানোর সময় বিজিবির সামনে পড়লে “কী বলতে হবে সেটাও শিখিয়ে দিয়েছিলো” বিএসএফ সদস্যরা।

“ওরা বললো যে, যদি ধরা পড়ো তাহলে বলবা যে আমরা ইন্ডিয়া যাচ্ছিলাম, সীমান্তে বিএসএফ তাড়া দেয়ায় আবার চলে আসছি।”

জাহানারা খাতুনকে যেভাবে পুশ ইন করা হয়েছে, বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহে এরকম চার শতাধিক মানুষকে পুশ ইন করে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠিয়েছে ভারত।

যাদের পুশ ইন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে যেমন রোহিঙ্গা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকও যারা অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে।

কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপারের ঘটনা কেন ঘটছে?

আর বাংলাদেশি নাগরিকদেরই কেউ কেউ কেন কাজের খোঁজে ভারতে যাচ্ছেন?

‘মুম্বাই থেকে বিমানে কলকাতা, তারপর পুশ ইন’

জাহানার খাতুনের সঙ্গে গত শনিবার একইদিনে পুশ ইনের পর বিজিবির হাতে আটক হন যশোরের নুরুন্নাহার, যিনি তিন বছর আগে ভারতের মুম্বাইয়ে গিয়েছিলেন কাজের খোঁজে।

“আমার এলাকার একজনের সঙ্গে মুম্বাই গিয়েছিলাম। সেখানে রুম ভাড়া করে থাকতাম। কাজ করতাম বিভিন্ন বাসাবাড়িতে,” বলছিলেন নুরুন্নাহার।

তার বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে, গেলো এপ্রিলের শেষ দিকে তিনি মুম্বাইয়ে ভারতীয় পুলিশের হাতে আটক হন।

সেখানে ১৫ দিন আটক রেখে যাচাই-বাছাইয়ের পর বিমানে করে তাদের পাঠানো হয় কলকাতা। এরপর কলকাতা থেকে বাসে করে আনা হয় বাংলাদেশ সীমান্তে।

গত ১৭ই মে ভোররাতে তাদের ঢুকিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও সীমান্তবর্তী এলাকায়।

নুরুন্নাহার বলছিলেন, “আমাকে রুম থেকেই সিআইডি ধরছিলো। এরপর যাচাই-বাছাই করে। আমার বাড়ি কোথায়, কবে আসছি এই জিজ্ঞাসা করে। পরে মোবাইলে আমার বাংলাদেশের ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেখাই। তারপর আমাকে কলকাতা হয়ে সীমান্তে নিয়ে আসে।”

নুরুন্নাহার ও জাহানারাসহ ১৭ জনকে একসঙ্গে সীমান্তে ঠেলে দেয় বিএসিএফ।

“মোট তিনটা গাড়ি ছিল। দুইটা গাড়ির লোকদের অন্য দিক দিয়ে পার করেছে। আর আমাদের পার করেছে আরেক দিক দিয়ে। ভূট্টা খেত, জঙ্গল, পানি এই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে অন্ধকারের মধ্যে আমরা এগুতে থাকি। আমরা তো এখানকার কিছুই চিনি না। পরে একসময় বিজিবি আমাদের দেখতে পেয়ে আটক করে,” বলেন নুরুন্নাহার।

বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক কয়েকজন

কাজের সন্ধানে ভারতে কেন?

দিনাজপুরের তরিকুল ইসলাম। সাত মাস আগে পাথর ভাঙার কাজে যোগ দিতে অবৈধভাবে গিয়েছিলেন ভারতের রাজস্থানে। কিন্তু দেশটিতে অবৈধ বাংলাদেশি ধরতে অভিযান শুরু হলে গতমাসে দেশে ফিরে আসেন তিনি।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, কাজের সন্ধানেই ভারত গিয়েছিলেন তিনি।

“বাংলাদেশেও কাজ আছে। কিন্তু এখানে বছরের বারো মাসের মধ্যে কাজ পাওয়া যায় তিন মাস। কিন্তু তিন মাসের ইনকাম দিয়ে কি গোটা বছর চলবে? ইন্ডিয়াতে যাই, সেখানে পাথর ভাঙার কাজ সবসময়ই পাওয়া যায়। মাসে আঠারো/বিশ হাজার টাকা ইন্ডিয়ান রুপি বেতন দেয়। কিন্তু থাকা-খাওয়ার খরচ কম। ফলে হাতে টাকা থাকে,” বলেন তরিকুল।

তিনি জানান, তার গ্রামের অনেকেই ভারতে গিয়ে কাজ করেছেন। তাদের টাকা পাাঠানোর খবরে তিনিও কাজে যেতে উৎসাহিত হন।

“ওখানে পাথর ভাঙার কাজটা নিঃশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর। প্রচুর ধূলা-বালি হয়। এই কাজগুলো বাংলাদেশিরাই করে। মালিকও জানে যে এরা বাংলাদেশ থেকে আসছে। কিন্তু কিছু বলে না। কারণ ওদের শ্রমিক দরকার। আর আমাদের দরকার টাকা,” বলেন তরিকুল ইসলাম।

তরিকুলের মতোই ভারতের রাজস্থানে গিয়েছিলেন পাশের পাশের গ্রামের খালেক মন্ডল। ভূমিহীন পরিবারের খালেক বলছেন, কৃষিকাজ ছাড়া আর কোনো কাজ পারেন না তিনি।

কিন্তু বাংলাদেশে কৃষিকাজের যে অবস্থা, তাতে সংসার চালানোর মতো সারা বছর কাজ পাওয়া যায় না।

“আমার তো পড়ালেখা নাই। ঢাকায় বা অন্য কোথাও যে যাবো, কে আমাকে চাকরি দেবে? এইজন্য ভারতে গেলাম। পাথর ভাঙার কাজ করলে মাসে বেতন পনের হাজার রুপি পাইতাম। প্রতিমাসে বাড়িতেও টাকা পাঠানো যায়,” বলেন খালেক মন্ডল।

কাঁটাতারে মই, বেড়া টপকে ভারতে

কিন্তু সীমান্তে যখন কাঁটাতারের বেষ্টনী এবং কঠোর নজরদারি, তখন কাজের জন্য অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার ঘটনা কীভাবে ঘটছে? আবার কাজের ফাঁকে অনেকেই বাংলাদেশে ফেরতও আসছেন। সেটাই বা কীভাবে হয়?

এমন প্রশ্নে দুটি উত্তর পাওয়া যায়। প্রথমটি হচ্ছে, কাঁটাতারের বেষ্টনি কেটে ভারতে ঢুকে পড়া। এ কাজে বড় আকারের প্লায়ার্স ব্যবহার করা হয়।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কাঁটাতারের ওপরে মই লাগিয়ে বেড়া টপকে ওপারে চলে যাওয়া।

তরিকুল ইসলাম জানাচ্ছেন, এই কাজে সহায়তা নিতে হয় দালালদের।

সীমান্তে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির নজরদারি

“সীমান্তের কাছে দালাল থাকে। আমরা বলি লাইনম্যান। প্রথমে লাইনম্যান আমাদেরকে আশ্রয় দেয়। তারপর যখন সীমান্তের নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় বিজিবি বা বিএসএফের কেউ থাকে না। তখন সুযোগ বুঝে মই লাগিয়ে দেয়া হয়। দুই পাশেই মই থাকে। আমরা পার হয়ে যাই। ওপারে আবার লাইনম্যান থাকে। সে আমাদের রিসিভি করে নেয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তরিকুল ইসলাম।

সম্প্রতি ভারত থেকে দেশে ফেরার সময় বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে বিজিবির হাতে আটক হন দিনাজপুরের স্বপন চন্দ্র সরকার।

অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপারের অভিযোগে তাকে পাসপোর্ট আইনে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে আদালত থেকে জামিন পান তিনি।

বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপকালে স্বপন চন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, লাইনম্যানকে এগারো হাজার টাকা দিয়ে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন।

“দুইপাশেই লাইনম্যান আছে। আমি এগারো হাজার টাকা দিয়ে পার হয়েছিলাম চার মাস আগে। এইবার ফেরার সময়ও এগারো হাজার টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঢোকার পর গ্রেপ্তার হয়ে যাই,” তিনি বলেন।

বাংলাদেশের সীমান্তে বিজিবির টহল কার্যক্রম নিয়মিত চললেও খোদ বিজিবিই বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছে যে বিশাল সীমান্ত এলাকা সার্বক্ষণিকভাবে নজরদারি সম্ভব নয়।

তবে এর মধ্যেই ভারত থেকে সাড়ে চারশত জনেরও বেশি মানুষের পুশ ইনের ঘটনা নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যাদেরকে পুশ ইন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আবার অন্তত ৪০ জন আছেন রোহিঙ্গা।

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই নাগরিকত্ব যাচাই করে কোনো বাংলাদেশি পাওয়া গেলে আইন মেনে হস্তান্তরের কথা বলেছে ভারতকে।

কিন্তু এই অনুরোধের পাশাপাশি বাংলাদেশি নাগরিকদের কেউ কেউ কেন অবৈধভাবে ভারতে ঢুকছে এবং এটা কীভাবে বন্ধ করা যাবে সেটাও এখন বাংলাদেশের সামনে বড় প্রশ্ন। বিবিসি

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

দৈনিক বার্তার অনলাইন ও মাল্টিমিডিয়ার প্রকাশনার সফলতা কামনা করলেন রোকেয়া রাজ্জাক জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সিদ্দিকুর রহমান হাওলাদার

যেভাবে পুশ ইন করছে বিএসএফ

Update Time : ০৫:২২:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

“বিএসএফ আমাদের বলেছে যে আমরা দুটো গুলি মারবো। গুলি মারার পরে তোমরা সব দৌড় মারবা। তো ওরা দুটো গুলি মারে। তখন আমরা সবাই ভেগে দৌড় মারি। সামনে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়ি।”

কথাগুলো বলছিলেন জাহানারা খাতুন। গত শনিবার ভোরে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও সীমান্তের ভেতরে তাকে আটক করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।

তার সঙ্গে সেদিন ১৭ জনকে আটক করে বিজিবি, যাদের প্রত্যেককেই ভারত থেকে পুশ ইন করা হয়েছিলো বলে বিজিবি পরে জানায়।

জাহানারা খাতুন বলছিলেন, ভারত থেকে ঠেলে বাংলাদেশে ঢোকানোর সময় বিজিবির সামনে পড়লে “কী বলতে হবে সেটাও শিখিয়ে দিয়েছিলো” বিএসএফ সদস্যরা।

“ওরা বললো যে, যদি ধরা পড়ো তাহলে বলবা যে আমরা ইন্ডিয়া যাচ্ছিলাম, সীমান্তে বিএসএফ তাড়া দেয়ায় আবার চলে আসছি।”

জাহানারা খাতুনকে যেভাবে পুশ ইন করা হয়েছে, বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহে এরকম চার শতাধিক মানুষকে পুশ ইন করে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠিয়েছে ভারত।

যাদের পুশ ইন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে যেমন রোহিঙ্গা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকও যারা অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে।

কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপারের ঘটনা কেন ঘটছে?

আর বাংলাদেশি নাগরিকদেরই কেউ কেউ কেন কাজের খোঁজে ভারতে যাচ্ছেন?

‘মুম্বাই থেকে বিমানে কলকাতা, তারপর পুশ ইন’

জাহানার খাতুনের সঙ্গে গত শনিবার একইদিনে পুশ ইনের পর বিজিবির হাতে আটক হন যশোরের নুরুন্নাহার, যিনি তিন বছর আগে ভারতের মুম্বাইয়ে গিয়েছিলেন কাজের খোঁজে।

“আমার এলাকার একজনের সঙ্গে মুম্বাই গিয়েছিলাম। সেখানে রুম ভাড়া করে থাকতাম। কাজ করতাম বিভিন্ন বাসাবাড়িতে,” বলছিলেন নুরুন্নাহার।

তার বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে, গেলো এপ্রিলের শেষ দিকে তিনি মুম্বাইয়ে ভারতীয় পুলিশের হাতে আটক হন।

সেখানে ১৫ দিন আটক রেখে যাচাই-বাছাইয়ের পর বিমানে করে তাদের পাঠানো হয় কলকাতা। এরপর কলকাতা থেকে বাসে করে আনা হয় বাংলাদেশ সীমান্তে।

গত ১৭ই মে ভোররাতে তাদের ঢুকিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও সীমান্তবর্তী এলাকায়।

নুরুন্নাহার বলছিলেন, “আমাকে রুম থেকেই সিআইডি ধরছিলো। এরপর যাচাই-বাছাই করে। আমার বাড়ি কোথায়, কবে আসছি এই জিজ্ঞাসা করে। পরে মোবাইলে আমার বাংলাদেশের ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেখাই। তারপর আমাকে কলকাতা হয়ে সীমান্তে নিয়ে আসে।”

নুরুন্নাহার ও জাহানারাসহ ১৭ জনকে একসঙ্গে সীমান্তে ঠেলে দেয় বিএসিএফ।

“মোট তিনটা গাড়ি ছিল। দুইটা গাড়ির লোকদের অন্য দিক দিয়ে পার করেছে। আর আমাদের পার করেছে আরেক দিক দিয়ে। ভূট্টা খেত, জঙ্গল, পানি এই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে অন্ধকারের মধ্যে আমরা এগুতে থাকি। আমরা তো এখানকার কিছুই চিনি না। পরে একসময় বিজিবি আমাদের দেখতে পেয়ে আটক করে,” বলেন নুরুন্নাহার।

বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক কয়েকজন

কাজের সন্ধানে ভারতে কেন?

দিনাজপুরের তরিকুল ইসলাম। সাত মাস আগে পাথর ভাঙার কাজে যোগ দিতে অবৈধভাবে গিয়েছিলেন ভারতের রাজস্থানে। কিন্তু দেশটিতে অবৈধ বাংলাদেশি ধরতে অভিযান শুরু হলে গতমাসে দেশে ফিরে আসেন তিনি।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, কাজের সন্ধানেই ভারত গিয়েছিলেন তিনি।

“বাংলাদেশেও কাজ আছে। কিন্তু এখানে বছরের বারো মাসের মধ্যে কাজ পাওয়া যায় তিন মাস। কিন্তু তিন মাসের ইনকাম দিয়ে কি গোটা বছর চলবে? ইন্ডিয়াতে যাই, সেখানে পাথর ভাঙার কাজ সবসময়ই পাওয়া যায়। মাসে আঠারো/বিশ হাজার টাকা ইন্ডিয়ান রুপি বেতন দেয়। কিন্তু থাকা-খাওয়ার খরচ কম। ফলে হাতে টাকা থাকে,” বলেন তরিকুল।

তিনি জানান, তার গ্রামের অনেকেই ভারতে গিয়ে কাজ করেছেন। তাদের টাকা পাাঠানোর খবরে তিনিও কাজে যেতে উৎসাহিত হন।

“ওখানে পাথর ভাঙার কাজটা নিঃশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর। প্রচুর ধূলা-বালি হয়। এই কাজগুলো বাংলাদেশিরাই করে। মালিকও জানে যে এরা বাংলাদেশ থেকে আসছে। কিন্তু কিছু বলে না। কারণ ওদের শ্রমিক দরকার। আর আমাদের দরকার টাকা,” বলেন তরিকুল ইসলাম।

তরিকুলের মতোই ভারতের রাজস্থানে গিয়েছিলেন পাশের পাশের গ্রামের খালেক মন্ডল। ভূমিহীন পরিবারের খালেক বলছেন, কৃষিকাজ ছাড়া আর কোনো কাজ পারেন না তিনি।

কিন্তু বাংলাদেশে কৃষিকাজের যে অবস্থা, তাতে সংসার চালানোর মতো সারা বছর কাজ পাওয়া যায় না।

“আমার তো পড়ালেখা নাই। ঢাকায় বা অন্য কোথাও যে যাবো, কে আমাকে চাকরি দেবে? এইজন্য ভারতে গেলাম। পাথর ভাঙার কাজ করলে মাসে বেতন পনের হাজার রুপি পাইতাম। প্রতিমাসে বাড়িতেও টাকা পাঠানো যায়,” বলেন খালেক মন্ডল।

কাঁটাতারে মই, বেড়া টপকে ভারতে

কিন্তু সীমান্তে যখন কাঁটাতারের বেষ্টনী এবং কঠোর নজরদারি, তখন কাজের জন্য অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার ঘটনা কীভাবে ঘটছে? আবার কাজের ফাঁকে অনেকেই বাংলাদেশে ফেরতও আসছেন। সেটাই বা কীভাবে হয়?

এমন প্রশ্নে দুটি উত্তর পাওয়া যায়। প্রথমটি হচ্ছে, কাঁটাতারের বেষ্টনি কেটে ভারতে ঢুকে পড়া। এ কাজে বড় আকারের প্লায়ার্স ব্যবহার করা হয়।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কাঁটাতারের ওপরে মই লাগিয়ে বেড়া টপকে ওপারে চলে যাওয়া।

তরিকুল ইসলাম জানাচ্ছেন, এই কাজে সহায়তা নিতে হয় দালালদের।

সীমান্তে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির নজরদারি

“সীমান্তের কাছে দালাল থাকে। আমরা বলি লাইনম্যান। প্রথমে লাইনম্যান আমাদেরকে আশ্রয় দেয়। তারপর যখন সীমান্তের নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় বিজিবি বা বিএসএফের কেউ থাকে না। তখন সুযোগ বুঝে মই লাগিয়ে দেয়া হয়। দুই পাশেই মই থাকে। আমরা পার হয়ে যাই। ওপারে আবার লাইনম্যান থাকে। সে আমাদের রিসিভি করে নেয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তরিকুল ইসলাম।

সম্প্রতি ভারত থেকে দেশে ফেরার সময় বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে বিজিবির হাতে আটক হন দিনাজপুরের স্বপন চন্দ্র সরকার।

অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপারের অভিযোগে তাকে পাসপোর্ট আইনে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে আদালত থেকে জামিন পান তিনি।

বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপকালে স্বপন চন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, লাইনম্যানকে এগারো হাজার টাকা দিয়ে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন।

“দুইপাশেই লাইনম্যান আছে। আমি এগারো হাজার টাকা দিয়ে পার হয়েছিলাম চার মাস আগে। এইবার ফেরার সময়ও এগারো হাজার টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঢোকার পর গ্রেপ্তার হয়ে যাই,” তিনি বলেন।

বাংলাদেশের সীমান্তে বিজিবির টহল কার্যক্রম নিয়মিত চললেও খোদ বিজিবিই বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছে যে বিশাল সীমান্ত এলাকা সার্বক্ষণিকভাবে নজরদারি সম্ভব নয়।

তবে এর মধ্যেই ভারত থেকে সাড়ে চারশত জনেরও বেশি মানুষের পুশ ইনের ঘটনা নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যাদেরকে পুশ ইন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আবার অন্তত ৪০ জন আছেন রোহিঙ্গা।

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই নাগরিকত্ব যাচাই করে কোনো বাংলাদেশি পাওয়া গেলে আইন মেনে হস্তান্তরের কথা বলেছে ভারতকে।

কিন্তু এই অনুরোধের পাশাপাশি বাংলাদেশি নাগরিকদের কেউ কেউ কেন অবৈধভাবে ভারতে ঢুকছে এবং এটা কীভাবে বন্ধ করা যাবে সেটাও এখন বাংলাদেশের সামনে বড় প্রশ্ন। বিবিসি