
পাবনা: পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত আরও আট কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বরখাস্তকৃতদের প্রকল্প এলাকা ও আবাসিক এলাকা গ্রিন সিটিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৩ মে) কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ও নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানির পরিচালক মো. জাহেদুল হাসান স্বাক্ষরিত দুটি পৃথক চিঠিতে এ তথ্য জানান।
তারা হলেন, এনপিসিবিএলের সহকারী ব্যবস্থাপক ইখতিয়ার উদ্দিন, শামীম আহম্মেদ, মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, মো. গোলাম, ঊর্ধ্বতন সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মনির, ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী গোলাম আজম, টেকনিশিয়ান রিয়াজ উদ্দিন ও ইসমাইল হোসেন।
নোটিশে বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকা ও এনপিসিবিএলে শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ডে ছিলেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না সেটি আগামী ১০ দিনের মধ্যে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বুধবার (১৪ মে ) রাতে রূপপুর প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস বলেন, বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের জেরে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কয়েকদিন আগেও ১৮ জনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি (টার্মিনেশন) দেওয়া হয়।
প্রকল্পের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বিভিন্ন দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ ২৮ এপ্রিল আন্দোলন শুরু করে। ৬ মে তারা ঈশ্বরদীতে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেন। পরদিন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে কোম্পানির অফিসে তারা অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করেন। এতে এনপিসিবিএল কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে চাকরিবিধি ও কোম্পানির আইন মেনে চলার চিঠি দেন। এরমধ্যে ১৩ মে তারা পুনরায় প্রকল্প এলাকায় বিক্ষোভ করে। এসময় প্রকল্পের বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরত ম্যানেজারদের হুমকি-ধমকি দেন তারা।
প্রসংগত: এর আগে শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ তাঁদের রূপপুর প্রকল্প ও গ্রিন সিটি বহুতল আবাসিক এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে পৃথক চিঠি দেওয়া হয়েছে। চাকরিচ্যুত ব্যক্তিরা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান স্বাক্ষরিত এক পত্রে এই অব্যাহতির কথা জানানো হয়। এতে ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যেককে শনিবার (১০ মে) রাতে ই-মেইলসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়। আগে,চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সূত্রে জানা গেছে, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. মো. জাহেদুল হাছান স্বাক্ষরিত অব্যাহতিপত্রে কোম্পানির ১৮ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা ঢাকায় আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। অব্যাহতি প্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রয়েছেন ১৫ জন বিএসসি এবং ৩ জন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার।
নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ হলেন, ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট হাসমত আলী (প্রধান কার্যালয়), উর্দ্বতন সহকারী ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম, আবু রায়হান, রফিকুল হাসান, আয়নাল হোসেন, নাঈম আল সাকিব, আবু সাঈদ, এ কে এম আব্দুল আল আমিন, শাহ ইখতিয়ার আলম, ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ, সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল আল নোমান, আসিফ খান, মুহাম্মদ ইমামুল আরেফিন, ইকরাম, রুহুল আমিন, উপ-সহকারী ব্যবস্থাপক ইসমাইল হোসেন, রুবেল হোসেন এবং টেকনিশিয়ান ফিরোজ আহমেদ। ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের মধ্যে উপ-সহকারী ব্যবস্থাপক রুবেল হোসেন জানান, এমডি ড. জাহেদুল হাছান রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংসের নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তার নানা অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও দূর্নীতির অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করায় আমাদেরকে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে।
অব্যাহতিপত্রে বলা হয়, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ইমপ্লইজ সার্ভিস রেজুলেশন’ ২০২৫ এর প্রবিধান ৫২.১ অনুযায়ী অব্যাহতি প্রদান করা হলো। একই সঙ্গে পৃথক আরেকটি পত্রে নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের রূপপুর প্রকল্প এলাকায় ও গ্রিণসিটিতে প্রবেশ বন্ধে অনুরোধ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে।
ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের মধ্যে উপ-সহকারী ব্যবস্থাপক রুবেল হোসেন জানান, এমডি ড. জাহেদুল হাসানের অপসারণসহ বিভিন্ন দাবী-দাওয়া নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করায় আমাদেরকে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জনৈক কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক স্পর্শকাতক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে রূপপুর প্রকল্প সার্বক্ষণিক আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার নজরদারিতে থাকে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আন্দোলন, সমাবেশ বিশ্বে নজিরবিহীন। নিরপত্তার শর্ত ভেঙে প্রকল্প এলাকায় মিছিল-সমাবেশ করে আন্দোলনকারীরা শুধু চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজই করেননি, প্রকল্পের অগ্রগতি ও পরবর্তী ধাপের লাইসেন্স প্রাপ্তিও হুমকিতে ফেলেছেন। ফলে, নীতিগত ভাবেই তাদের চাকুরিতে বহাল থাকার কোন সুযোগ নেই। তাদের অন্য কোন চক্রান্তে যোগসাজশ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পের কর্মীদের চাকুরী সংক্রান্ত অভাব অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের হঠকারী আচরণে মনে হয়েছে তারা পরিকল্পিত ভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে মাঠে নেমেছে। নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের দাবির যৌক্তিকতা বিচার করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা তা শুনতে নারাজ।
সূত্রটি আরো জানায়, এনপিসিবিএল এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকার মালিকানাধীন দেশের সকল প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশী বেতন পেয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি জানান, এনপিসিবিএলে ৭ম গ্রেডের কর্মকর্তা সিনিয়র এসিটেন্ট ম্যানেজারের মূল বেতন ৭৫,৬০০ টাকা। বাড়ী ভাড়া ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ হারে ৩০,২৪০ টাকা থেকে ৪৫,৩৬০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ২৫০০ টাকা, স্পেশাল এলাউন্স ৫ শতাংশ হারে ৩৭৮০ টাকা এবং ৪০ শতাংশ প্রজেক্ট ভাতা ৩০২৪০ টাকাসহ সাকুল্যে ১,৪২,৩৬০ টাকা পান। এরসাথে ৪ শতাংশ ইনক্রিমেন্টও পান। একই ভাবে অন্যান্য গ্রেডের কর্মকর্তারাও সরকারী অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে অনেক বেশী বেতন পেয়ে থাকেন। তাস্বত্তেও তারা নানা দাবিতে আন্দোলন-হট্টগোল করেছেন। এমনকি নির্মাণ ও অর্থায়নকারী রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান ও কর্মকৌশল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও বিষোদগার করেছেন। যা এই প্রকল্পের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এ বিষয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান বলেন, নীতিমালা ও চাকুরী বিধি অনুযায়ী অব্যাহতি প্রাপ্তদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর বেশী কিছু আমার বলার নেই।
বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ঈশ্বরদীর রূপপুরে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ গত ২৮ এপ্রিল থেকে আন্দোলন শুরু করেন। ৬ মে তাঁরা ঈশ্বরদী শহরে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেন। পরদিন ৭ মে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে কোম্পানির অফিসে তারা অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করেন। এতে এনপিসিবিএল কর্তৃপক্ষ তাঁদের চাকরিবিধি ও কোম্পানির আইন মেনে চলার জন্য চিঠি দেয়।
ঈশ্বরদি প্রতিবেদক 



















