উপস্থিত আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘শুনানির সময় কেউ পাশ থেকে কথা বলবেন না। এজলাসের ভেতরে কেউ ছবি তুলবেন না।’ আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এমন কিছু বলবেন না যেন অডিয়েন্সে (উপস্থিত শ্রোতা) বিশৃঙ্খলা হয়।’

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাবেক সংসদ সদস্য সংগীতশিল্পী মমতাজ বেগমের রিমান্ড শুনানি ঘিরে নানা দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকেন্দ্রিক রাজধানীর মিরপুর মডেল থানার একটি হত্যা মামলায় এ শিল্পীকে আদালতে হাজির করা হলে আইনজীবীদের মধ্যে বেশ হট্টগোল শুরু হয়। পরে আদালত তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তার বক্তব্যে মমতাজের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং বিতর্কিত মন্তব্যগুলো তুলে ধরেন, যা এজলাসে হাসির রোল তোলে। অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবীকে খুঁজতে বেগ পাওয়া এবং রিমান্ডের মেয়াদ নিয়ে আইনজীবীদের অসন্তোষে আদালতকক্ষ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এরপর মহানগর প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জাতি হিসেবে আবেগপ্রবণ। একজন ফুটবলার ভালো খেললে আমরা তার খেলাটাই দেখি। তাকে পছন্দ করার কারণ তিনি ভালো খেলেন। তেমনিভাবে নায়িকার অভিনয়, শিল্পীর ভালো গান আমরা পছন্দ করি। তারা কোন দল করে সেটা দেখা হয় না। তাদের কাজটাকে আমরা ভালোবাসি।’
‘তবে এই আসামি জনগণের ভালোবাসাটাকে ব্যবহার করে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব যখন আরেক রাষ্ট্রের কাছে জিম্মি; গুম, আয়নাঘর, আন্দোলন করলেই যখন গুলি করা হয়, তখন এই মমতাজ গানের ভালোবাসা দিয়ে ফ্যাসিস্টকে সহযোগিতা করে গেলেন। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের মানুষের ভোট হরণ করলেন। সংসদের অধিবেশনে যেখানে মিনিটে কোটি টাকা খরচ হয় সেখানে তিনি গান গাইলেন— ‘আমার নেত্রী শেখ হাসিনা, সারা বিশ্বে নাই তার তুলনা।’ সংসদে তোফায়েল, আমুসহ অন্য সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতারা যেখানে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে কটু কথা বলেননি, সেখানে তিনি বক্তব্য রাখলেন ‘খালেদার বাপের নাম কি?’
শুনানির সময় জনাকীর্ণ এজলাসের কাঠগড়ায় পুরো সময় গালে হাত দিয়ে বিষণ্ন মনে পিপির বক্তব্য শুনতে দেখা যায় মমতাজকে। একপর্যায়ে পিপি আদালতকে বলেন, ‘এই আন্দোলনের সময় যখন হাসিনার মন খারাপ থাকত তখন তিনি হাসিনাকে গান শোনাতেন।’ এ সময় এজলাসে হাস্যরসের তৈরি হয়। পিপির বক্তব্য শুনে বিষণ্ণ মমতাজ নিজেও তখন হেসে দেন।
কিছুটা সময় নিয়ে মমতাজ তার আইনজীবীকে শনাক্ত করে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেন। তবে ওই আইনজীবী আদালতের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আজকে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’ এরপর আদালত বেলা ৩টা ২৮ মিনিটে মমতাজের চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন। রিমান্ডের আদেশ শুনে আইনজীবীরা বলে ওঠেন, ‘চার দিন না, চার দিন না, সাত দিনের রিমান্ড দিতে হবে।’
এরপর মমতাজকে আদালত থেকে হাজতখানায় নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। তখন আইনজীবীরা বলেন, ‘তাকে লিফটে নেওয়া যাবে না। সিঁড়ি দিয়ে নামাতে হবে। বিএনপির অনেক নেতাকে লিফটে নিতে দেওয়া হয়নি। হেঁটে-হেঁটে তোলা হয়েছে। তাকে সাত তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে।’ পরে এজলাসের গেটের সামনে অবস্থান নেন আইনজীবীরা। তারা এ সময় বেশ উচ্চবাচ্য করেন। তখনো আদালতে বিচারকাজ চলছিল।
পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার ইন্সপেক্টর মো. জাহিদুল ইসলাম আদালতকে বলেন, ‘যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, আসামিকে কিছুক্ষণ কাঠগড়ায় রাখা হোক।’ তখন বিচারক বলেন, ‘আপনি পারলে লিফটে নামিয়ে নিয়ে যান।’
তখনও এজলাসে কয়েকজন আইনজীবী অবস্থান করে চিৎকার করছিলেন। পরে আদালত আইনজীবীদের এজলাস ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকীও আইনজীবীদের এজলাস ত্যাগ করতে বলেন। তখন আইনজীবীরা গেটের সামনে অবস্থান নেন।
প্রায় ২১ মিনিট এজলাসে রাখা হয় মমতাজকে। পরে নিরাপত্তা বাড়িয়ে তাকে লিফটে তুলে নিচে নামানো হয়। কিন্তু নিচে গিয়েও অবস্থান নেন আইনজীবীরা। পরে নিচ থেকে দ্রুত মমতাজকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেসময় আইনজীবীরা মমতাজকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন ভাষায় কটূক্তি করেন।
গতকাল সোমবার দিবাগত রাত পৌনে ১২টায় রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে মমতাজকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ জুলাই মিরপুর-১০ নং গোল চত্বর এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন মো. সাগর। ওইদিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আসামিরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও গুলিবর্ষণ করেন। এ সময় ভুক্তভোগী সাগরের বুকে গুলি লেগে পেছন দিকে বের হয়ে যায়। তার মা . বিউটি আক্তার তাকে খুঁজতে থাকে। একপর্যায়ে ওইদিন দিবাগত রাত ৩টায় মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার লাশের সন্ধান পান তিনি। পরে সন্তানের লাশ গ্রহণ করে গ্রামের বাড়িতে দাফন সম্পন্ন করেন।
এ ঘটনায় গত ২৭ নভেম্বর নিহতের মা বিউটি আক্তার বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন। এতে শেখ হাসিনাসহ ২৪৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া, মামলায় ২৫০ থেকে ৪০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এ মামলার মমতাজ বেগম ৪৯ নং এজাহারনামীয় আসামি।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, ‘মামলার ঘটনাটি সরেজমিনে পরিদর্শনপূর্বক গোপনে ও প্রকাশ্যে প্রাথমিক তদন্তে এ আসামির মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই আসামি মামলার এজাহারনামীয় ৪৯ নং অসামি। তিনি মানিকগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবং সিঙ্গাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এই আসামি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাবেশ/আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে নিপীড়নে ক্যাডার বাহিনীকে উৎসাহিত করতো। মামলার এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাতপরিচয় পলাতক আসামিদের নির্দেশে, প্ররোচনায় এবং মদতে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের ক্যাডাররাসহ মমতাজের ক্যাডাররা বেপরোয়াভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাবেশ/আন্দোলনে আক্রমণ করে নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে এবং তাদের ছোড়া গুলিতে মো. সাগর গুলিবিদ্ধ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মামলার মূল রহস্য উদঘাটনসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত পলাতক আসামিদের অবস্থান নির্ণয় করতে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।’
Reporter Name 


















