
গুম সংক্রান্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা এখনো হাতে পায়নি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তবে ১৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়ার তথ্য জানিয়েছে তারা।
আজ বিকেলে ঢাকায় আর্মি অফিসার্স মেসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো.হাকিমুজ্জামান।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম করে নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা দুটি মামলায় ৩০ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বুধবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাদেরকে আগামী ২২ তারিখের মধ্যে গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে।
এই পরোয়ানায় সাবেক ও কর্মরত কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার নাম আছে।এই সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও বিচার নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনাও চলছে। এরই মধ্যে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সেনাবাহিনী।
সেখানে মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান জানান, দুটি মামলার ৩০ জন আসামির মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত, একজন এলপিআরে গেছেন এবং বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ১৫ জন।
তিনি জানান, সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেফতারি পরোয়ানা এখনো তাদের হাতে পৌঁছেনি এবং পুলিশের পক্ষ থেকেও তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।
"আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে" সেনা কর্মকর্তাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে এবং "প্রয়োজন অনুযায়ী" তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এক প্রশ্নের উত্তরে মেজর জেনারেল হাকিমুজ্জামান জানান, সেনাবাহিনী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে, তবে " আইসিটির এই বিষয়টায় অবশ্যই আমাদের মোরালে অ্যাফেক্ট করবে"।
[caption id="attachment_9912" align="aligncenter" width="300"]
সেনাবাহিনীর সংবাদ সম্মেলন[/caption]
"সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি সেনাবাহিনী শ্রদ্ধাশীল" এই কথা উল্লেখ করে মি. হাকিমুজ্জামান জানান, গত ৮ই অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং টিভি স্ক্রল বা গণমাধ্যম থেকে জানার পরপর সেদিনই এলপিআরের একজনসহ ১৬ জন কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই সেনা কর্মকর্তা জানান, "একজন বাদে ১৬ জনের মধ্যে ১৫ জনই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সেনা সদরে জয়েন করেছে। শুধু একজন যোগাযোগ করেননি বিধায় পরিবারের সাথে যোগাযোগ করি। শুধুমাত্র মেজর জেনারেল কবির হেফাজতে আসেননি।"
"নয় তারিখে তিনি (মেজর জেনারেল কবির আহাম্মদ) বাসা থেকে বের হন আইনজীবীর সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত আর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেননি। সে হিসেবে তিনি একটা ইললিগ্যাল অ্যাবসেন্টে আছেন। ইললিগ্যাল অ্যাবসেন্স ঘোষণা করে প্রসিডিউর নেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি যেন দেশের বাইরে যেতে না পারে সেজন্য সকল পোর্টে বলা হয়েছে," জানান মেজর জেনারেল মি. হাকিমুজ্জামান।
তবে এই কর্মকর্তারা এখন আর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তারা সেনা হেফাজতে আছেন, নাকি সেনা সদরে সংযুক্ত হয়েছেন–– এমন প্রশ্নে পরে তিনি উল্লেখ করেন, "তারা হেফাজতে আছেন। তবে যেহেতু বেতন ও রেশন সংক্রান্ত নানা হিসাব রাখতে হবে তাই সংযুক্তির আদেশ দেওয়া হয়েছে।"
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি জানান, "গুম কমিশন কাজ করছে। আর্মি আরেকটা কমিশন করলে সেটাকে আন্ডারমাইন করা হবে। এই কমিশনকে যতটুকু সাহায্য করার সেটা করছি। সেনাপ্রধান আবারো জানিয়েছেন আমরা জাস্টিসের পক্ষে, নো কম্প্রোমাইজ উইথ ইনসাফ।"গুমের বা নির্যাতনের শিকার পরিবারগুলোর প্রতি তাদের সহানুভূতি আছে বলেও জানান বলেন মো. হাকিমুজ্জামান।

প্রসঙ্গত, গত ছয়ই অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে এক সংশোধনী এনেছে।
ওই সংশোধনী অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেই ব্যক্তি সরকারি চাকরিজীবী হলে ওই পদে থাকতে পারবেন না বলে ট্রাইব্যুনালের একাধিক প্রসিকিউটর জানান।
ছয়ই অক্টোবরের প্রজ্ঞাপনের ফলে অভিযোগ দাখিলের পর আর সরকারি চাকরিরত এই সেনা কর্মকর্তাদের চাকরি থাকে না–– এই প্রশ্ন করা হলে মেজর জেনারেল হাকিমুজ্জামান জানান, সেই প্রজ্ঞাপনের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।
কিছু কর্মকর্তার এমন অপরাধের দায় সেনাবাহিনী নেবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি 'দায় নেওয়া উচিত কি না' বলে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।
সামরিক কর্মকর্তাদের বিচার কীভাবে হবে সেই প্রশ্নও তৈরি হয়েছিল চার্জশিটে তাদের নাম আসার পর। এক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর নিজস্ব আইনে সামরিক আদালতে, নাকি প্রচলিত ফৌজদারি আইনে বিচার করা যাবে- এমন প্রশ্নও তৈরি হয়।
এ প্রসঙ্গে আইনজীবী ও সাবেক সেনা কর্মকর্তারা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, ট্রাইব্যুনাল বা ফৌজদারি আইনে সেনা কর্মকর্তা বা সেনা সদস্যদের বিচার হতে কোনো বাধা নেই।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা বিষয়টি জানতে চাইলে মেজর জেনারেল হাকিমুজ্জামান বলেন, তারা একইসাথে আইসিটি (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) ও সেনা আইন "মুখোমুখি করতে চান না"।
সাবেক কর্মকর্তাদের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাবেক কর্মকর্তারা সেনা আইনের আওতায় পড়েন না। তবে তারা চাইলে সেনাবাহিনীর হেফাজতে আসতে পারেন, অথবা আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন।
পুলিশ চাইলে তাদের গ্রেফতার করতে পারে বলেও জানান তিনি।
ডিজিএফআই নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি উল্লেখ করেন, র্যাব ও ডিজিএফআই সেনাবাহিনীর অধীনে না। র্যাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ডিজিএফআই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (বর্তমানে যা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়) অধীনে। তাই অভিযুক্তরা সেনা কর্মকর্তা হলেও সেখানে সেনাবাহিনীর কথা বলার এখতিয়ার নেই।
২২ শে অক্টোবর তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা যাবে কি না এমন প্রশ্নে জানান, আইনি উপায়েই সমাধান করা হবে।