
আয়া ছাড়া পরিবার পরিকল্পনায় স্থায়ী পদ্ধতি বা দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। কিন্তু পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে ৮ টি আয়ার পদ থাকলেও ৭ টি আয়া পদ শূন্য রয়েছে। আছে মাত্র ১ জন আয়া। পাশাপাশি ঈশ্বরদী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে টানা ১০ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে পরিবার পরিকল্পনার ওষুধ ও সামগ্রী সরবরাহ। এতে করে চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। স্থায়ীপদ্ধতি বা দীর্ঘ মেয়াদী কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। ফলে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় দম্পতিদের বাড়ছে অনিয়ন্ত্রিত গর্ভধারণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির শঙ্কা।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার সদর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশাপাশি ৭ টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও ৪৪টি স্যাটেলাইট ক্লিনিক রয়েছে। অনেক জায়গায় ভিজিটর না থাকার কারণে ২৮ টি সেটেলাইট ক্লিনিক করা সম্ভব হচ্ছে।এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে নিয়মিত সেবা নেন উপজেলার কয়েক হাজার দম্পতি, মা ও শিশু। কিন্তু গত ১০ মাস ধরে পরিবার পরিকল্পনার জন্য ২২ ধরণের ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ ঔষধ পাওয়া যায় ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর। তারপর থেকে আর ঔষধ পাওয়া যায়নি।পাশাপাশি জনবল সংকটে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম। উপজেলায় ৮টি আয়ার পদ থাকলেও ৭ টি পদ শূন্য রয়েছে এবং বর্তমানে আছেন একজন মাত্র। এম এল এস এস পদ শূন্য ৮ টি,আছে তিন জন, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ( SACMO ) শুন্য পদ ৭ বর্তমানে আছে ৪, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা শূন্য পদ ১১ বর্তমানে আছে ৬ জন, পরিবার পরিকল্পনা সহকারী পদ শূন্য আছে ৪৭ বর্তমানে আছে ৩৩ জন।
সরেজমিনে বিভিন্ন ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, নেই প্রয়োজনীয় কনডম, পিল, ইমপ্ল্যান্ট, আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট। এতে করে গর্ভবতী মা ও কিশোরীরা স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেবাদান কেন্দ্রগুলো খোলা থাকলেও ওষুধ না থাকায় হতাশ হয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাঁড়া ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনা অফিস থেকে
বলেন, আমরা শুধু পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু রোগীরা ওষুধ না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ফিরে যায়।
একই অবস্থা উপজেলার অন্যান্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রেও। কয়েকটি ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা অফিসে কর্মরত ডাক্তার
জানান, আগে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন মা ও শিশুসহ সাধারণ রোগী আসতেন । এখন সে সংখ্যা নেমে এসেছে ৫ থেকে ১০ জনে। ওষুধ না পেয়ে মানুষ আর আসছে না।
রোগীরা এখন ওষুধ না থাকার কথা আগেই ফোনে জেনে নেয়। অনেকে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। আমরা শুধু রক্তচাপ মেপে কিছু পরামর্শ দিয়ে বিদায় জানাই।
উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি নিজে কয়েকদিন এসে ওষুধ না পেয়ে ঘুরে গেছি। এখানে গরীব-দুখী মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে। ওষুধ না পেয়ে সবাই হতাশ হয়ে ফিরে যায়। ওষুধ চাইলে ক্লিনিকের ডাক্তার বলে ওষুধ নেই।’
একই গ্রামের আব্দুল মালেক বলেন, ‘‘আমরা গরীব-দুখী যারা আছি তারা এখানেই চিকিৎসা নিতে আসি। অনেকদিন ধরে ঘুরছি এখানে এসে ওষুধ পাই না। ওষুধ চাইলেই বলে, ‘ওষুধ আসে না, আমরা কোথা থেকে দিবো।’ তাই এখানে এসে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়। এখানকার বিনামূল্যের ওষুধ পেলে আমাদের খুব উপকার হয়।’’
উপজেলার ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবস্থা প্রায় সবগুলোরই একই চিত্র। ১০ মাস ধরে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে । ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ। এসব ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মাস শিশুসহ সাধারণ রোগীদের এসে শুধু পরামর্শ নিয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে ।
পরিবার পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিটি সেবাকেন্দ্রে প্রতি মাসে ৫০০ সেট খাবার বড়ির চাহিদা থাকলেও বর্তমানে বরাদ্দ মিলছে মাত্র ২০-১০০টি। তাছাড়া এ বছরের জুন মাস থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি ইমপ্ল্যান্টের সরবরাহ। ইনজেকশন থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় সিরিঞ্জ। ডিডিএস কিটেরও তীব্র সংকট চলছে।
এদিকে, সেবা না পাওয়ায় অনেক পরিবার এখন নিজেদের খরচে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনেছেন। এতে নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য সমস্যা তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন সেবা-গ্রহণকারী লোকজন।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে সেবা নিতে আসা স্থানীয় বাসিন্দা রুনা বেগম বলেন, ওষুধ না থাকায় এখন বাধ্য হয়ে ফার্মেসি থেকে কিনে খেতে হচ্ছে। আগে বিনামূল্যে যেটা পেতাম, এখন খরচ করতে হচ্ছে। আমাদের মতো গরিবের পক্ষে নিয়মিত কেনা সম্ভব না।
নাম না প্রকাশের শর্তে স্থানীয় এক যুবক বলেন, স্ত্রীর জন্য পিল আর ক্যালসিয়াম নিতে গিয়ে ফার্মেসিতে গিয়েছি। সব কেনা সম্ভব না। এই জন্য সরকারি কেন্দ্রের উপর ভরসা করেছিলাম।
এ বিষয়ে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাকিলা পারভীন কেয়া বলেন, উপজেলায় সেবা দিতে আমরা আন্তরিক। কিন্তু ঊর্ধ্বতন দপ্তর থেকে দীর্ঘদিন ওষুধ সরবরাহ না থাকায় এবং জনবল সংকটে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি । বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার জানানো হলেও সমাধান আসেনি। তবে পরিবার পরিকল্পনার সার্জারি ক্যাম্প চালু আছে। পাবনা থেকে ডাক্তার এসে মাসে ২-৩ টি ক্যাম্প করা হয়।
আলমাস আলী, ঈশ্বরদী (পাবনা ) প্রতিবেদক 



















