
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে 'তৌহিদি জনতা' পরিচয়ে নুরুল হক ওরফে 'নুরাল পাগলা' এর কবর, বাড়ি ও দরবার শরিফে হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এমনকি মরদেহ কবর থেকে তুলে মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা।
শুক্রবার দুপুরের পর হামলার এই ঘটনায় আহতদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
আহত অন্তত ২১ জন রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, শুরুতে নুরাল পাগলার আস্তানায় দলবেধে প্রবেশের চেষ্টা করে একদল ব্যক্তি। এসময় মাজারের ভক্ত ও বিক্ষুব্ধদের মধ্যে ইটপাটকেল ছোঁড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে।
একপর্যায়ে মাজারের দেয়াল টপকে ভিতরে ঢুকে মাজারে থাকা অনেককে মারধর ও স্থাপনা ভাঙচুর শুরু করে একদল ব্যক্তি। এর আগে পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে।
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, গোয়ালন্দ পৌরসভার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের জুড়ান মোল্লাপাড়া এলাকার এই মাজারটি ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই জটিলতা চলছিল।
নুরুল হকের মৃত্যুর পর গত কয়েক মাসে পুরনো মতবিরোধ বেড়েছিল, যা সমাধানে দুই পক্ষের সঙ্গেই কয়েক দফা আলোচনা হয়েছিল বলেও জানান রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক।
এই ঘটনায় পুলিশের ওপরও হামলা হয়েছে বলে জানান জেলার পুলিশ সুপার। তিনি বলছেন, আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা চলছিল, কিন্তু হঠাৎই হামলা-ভাঙচুর চালানো হলো। এই ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে মাজারে হামলা ও ভাংচুরের এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে ওই বিৃবতিতে।
গোয়ালন্দের নুরাল পাগলার মাজারটি সরানোর দাবিতে এর আগেও বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচীও পালন করা হয়েছে।
গত ২৩শে অগাস্ট নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার মৃতুর পর তার কবর ও দরবার শরিফের কর্মকাণ্ড নিয়ে পরিস্থিতি আবারো জটিল আকার ধারণ করে।
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, একসময় নিজেকে ইমাম মাহাদি বলে দাবি করেছিলেন নুরুল হক নামে ওই ব্যক্তি। এমনকি মৃত্যুর পর তার মরদেহ ওই মাজারের ভেতরে মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় দাফন করা হয়। যা নিয়ে তখন থেকেই ক্ষোভ জানিয়ে আসছিলেন স্থানীয় আলেম সমাজ।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে ওই মাজারে অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ তোলা হয়।
এছাড়া বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর সমতল করাসহ বিভিন্ন দাবি না মানলে শুক্রবার জুমার নামাজের পর 'মার্চ ফর গোয়ালন্দ' কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে জানান, এলাকার আনসার ক্লাব চত্বরে জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেছিল উপজেলার 'ইমান ও আকিদা রক্ষা' কমিটি। দুপুরের পর ওই কর্মসূচিতে দেশী অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে অংশ নেন একদল ব্যক্তি।
তারা বলছেন, শুরুতে পুলিশ ও স্থানীয় মুরব্বিরা তাদেরকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও উত্তেজিত হয়ে পুলিশের দুটি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার একটি গাড়িতে ভাঙচুর করে তারা। এসময় মাজারের ভক্ত ও তৌহিদি জনতার মধ্যে ইটপাটকেল ছোঁড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে।
সে সময় সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। আগুন নেভানোর পাশাপাশি আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় ফায়ার সার্ভিস।
মাজারে হামলা বন্ধের এক পর্যায়ে নুরুল হকের বাড়িতে গিয়েও হামলা চালানো হয়। অভিযোগ উঠেছে, এসময় বাড়ির সামনে থাকা তার কবর থেকে মরদেহ তুলে খানিক দূরে মহাসড়কে নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা।
এসব ঘটনার ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এবং চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
পুলিশ বলছে, দিনভর উত্তেজনার পর পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। এই ঘটনায় গুরুতর আহত তিনজনকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়েছে, বাকি দুজনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানায় পুলিশ।
রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম বলেন, "শুক্রবার জুমার নামাযের পর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশের কথাও পুলিশকে জানানো হয়েছিল, সেই মোতাবেক আমাদের ফোর্সও ওই এলাকায় মোতায়েন ছিল। কিন্তু হঠাৎ প্রতিশ্রুতি না রেখে একটি পক্ষ দেশীয় অস্ত্র আর ইট-পাটকেল নিয়ে মাজারে হামলা করে বসে।"
এলাকা থেকে মাজারটি সরিয়ে নেয়ার দাবিতে আশপাশের অনেকেই কয়েক মাস যাবৎ নানা কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন বলে জানায় জেলা প্রসাশন। দুই পক্ষের সঙ্গেই বেশ কয়েকবার এ নিয়ে প্রশাসনের বৈঠক হয়েছে বলেও জানান রাজবাড়ীর জেলা প্রসাশক সুলতানা আক্তার।
তিনি বলছেন, "কয়েক দফায় আলোচনার পরও দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড় ছিল।"
মাজারে হামলার এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেখানে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গোয়ালন্দে নুরুল হক মোল্লা, যিনি নুরা পাগলা নামেও পরিচিত, তাঁর কবর অবমাননা ও মরদেহে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানায়। এই অমানবিক ও ঘৃণ্য কাজটি আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের আইন এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সভ্য সমাজের মৌলিক ভিত্তির ওপর সরাসরি আঘাত।"
এই ধরনের বর্বরতা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া এই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
সরকার বলছে, "আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এবং প্রতিটি মানুষের জীবনের পবিত্রতা, জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"
কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয় উল্লেখ করে বিবৃতিতে জানানো হয়, যারা এই ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে দ্রুত ও কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া দেশের সব নাগরিককে ঘৃণা ও সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ন্যায়বিচার ও মানবতার আদর্শকে সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট থাকার কথাও বলা হয়েছে বিবৃতিতে।