ঢাকা ০৫:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ২৪ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জীবন্ত মানুষের কবর

আর্তুরো সুয়ারেজ বলছেন যে এল সালভাদোরের কুখ্যাত সিসোট কারাগারে তাকে আনার পরেই প্রহরীরা তাকে মারধর করে। জ্ঞান ফিরে আসার পরে তিনি খেয়াল করেন যে তার চশমাটা ভেঙে গেছে – সবকিছু ঝাপসা লাগছিল তার চোখে, তবে তাকে যেভাবে সম্ভাষণ করা হয়েছিল, সেটা তিনি স্পষ্টই শুনতে পেয়েছিলেন:

“জাহান্নামে স্বাগত। জীবিত মানুষের কবরস্থানে স্বাগত। কেবলমাত্র মৃত অবস্থাতেই এখান থেকে বেরতে পারবেন।”

অর্তুরো বলছেন, তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন যিনি, তিনি কারাগারের পরিচালক বেলার্মিনো গার্সিয়া।

সিসোট, বা ‘সেন্টার ফর দ্য কনফাইনমেন্ট অফ টেররিজম’ এল সালভাদোরের হিংস্রতম ও সবথেকে বিপজ্জনক গ্যাংস্টারদের গণহারে বন্দি করে রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। একের পর এক যেসব খুন ও চাঁদাবাজির ঘটনা দেশটিকে আতঙ্কিত করে রেখেছিল তা রোধ করতে প্রেসিডেন্ট নাঈব বুকেলে যে কঠোর পন্থা নিয়েছেন, তারই প্রতীক হয়ে উঠেছে এই বন্দিশালা।

২০২৩ সালে এই কারাগার চালু হওয়ার পর থেকে লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম এই বন্দিশালার ভিতরের অবস্থা সম্পর্কে কর্মকর্তারা কখনও মুখ খোলেন না। হাতে গোনা কয়েকজন বন্দি এই কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তাই কংক্রিটের প্রাচীর আর বিদ্যুতায়িত বেড়ার ভিতরে যে আসলে কী হয়, সে ব্যাপারে খুবই কম তথ্য পাওয়া যায়।

তবে আর্তুরোসহ আরও ২৫১ জন ভেনেজুয়েলার নাগরিককে সম্প্রতি সিসোট কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অভিবাসীদের গণহারে প্রত্যর্পন করাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে নীতি নিয়েছেন, তারই অধীনে এল সালভাদোর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে হওয়া এক চুক্তি অনুযায়ী এই বন্দিদের গত মার্চ মাসে সিসোট কারাগারে পাঠানো হয়।

গত মাসে ভেনেজুয়েলায় নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরেছেন এরা। তাদের ঘিরে একদিকে যেমন আনন্দোৎসব হয়েছে, তেমনই চোখের জলও ফেলেছেন অনেকে। কারাগারের ভিতরে কেমন ছিল তাদের জীবন, তা নিয়ে বিবিসি মুন্ডোর সঙ্গে কথা বলছেন মুক্তি পাওয়া আটজন। তারা জানিয়েছেন কীভাবে নিয়মিত তাদের মারধর করা হতো, কখন হাত বেঁধে লাঠি দিয়েও মারা হতো তাদের। একজন বলেছেন প্রহরীরা তাকে যৌন নির্যাতনও করেছে।

মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিরা বলেছেন কোনও চাদর বা তোষক ছাড়াই ধাতব বিছানায় তাদের শুতে হতো, খেতে হতো হাত দিয়ে। তাদের সঙ্গে বাইরের কোনও যোগাযোগ ছিল না, কোনও আইনজীবীও ছিল না তাদের। সময়ের হিসাবও রাখতে পারেননি তারা – কারণ কোনও ঘড়ি ছিল না সেখানে।

২৩ থেকে ৩৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রে বাস করতেন। এদের মধ্যে কেউ আমেরিকার আইন মেনে সেদেশে প্রবেশ করেছিলেন, কেউ আবার বেআইনি পথে গিয়েছিলেন সেখানে। তবে সবার বিরুদ্ধেই অভিযোগ করা হয়েছিল যে তারা এল সালভাদোরের সহিংস গোষ্ঠীগুলির সদস্য। তাদের সেকারণে প্রত্যর্পন করা হয়।

কোনও গ্যাং কিংবা অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগ অবশ্য তারা প্রত্যেকেই অস্বীকার করেছেন এবং এটাও বলেছেন যে তাদের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করার কোনও সুযোগই তারা পাননি। এদের বেশিরভাগই মনে করেন যে তাদের গায়ে নানা ধরনের ট্যাটু থাকার ফলেই তাদের চিহ্নিত করা হয়েছিল – কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দাবি করেন যে ওইসব ট্যাটুগুলি আসলে ভেনেজুয়েলায় গড়ে ওঠা একটা শক্তিশালী অপরাধ গোষ্ঠী ট্রেন দ্যে আরাগুয়া-র সঙ্গে যুক্ত থাকার চিহ্ন।

ভেনেজুয়েলার অভিবাসীদের ছবি: উপরের সারিতে - জোয়েন সুয়ারেজ, আর্তুরো সুয়ারেজ, উইলকেন ফ্লোরেজ, অ্যান্ড্রি হার্নান্দেজ। নিচের সারিতে - অ্যান্ডি পেরোজো, মার্ভিন ইয়ামার্তে, এডুয়ার হার্নান্দেজ, রিঙ্গো রিনকন
উপরের সারিতে – জোয়েন সুয়ারেজ, আর্তুরো সুয়ারেজ, উইলকেন ফ্লোরেজ, অ্যান্ড্রি হার্নান্দেজ। নিচের সারিতে – অ্যান্ডি পেরোজো, মার্ভিন ইয়ামার্তে, এডুয়ার হার্নান্দেজ, রিঙ্গো রিনকন

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বিতাড়িত অভিবাসীদের সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কী কী প্রমাণ ব্যবহার করা হয়েছে এই প্রশ্নের জবাব তারা দেয়নি।

পায়ের গোড়ালি আর হাতের কব্জি শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় তাদের বিমানে তোলার সময়ে ওই অভিবাসীদের ধারণা হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের ভেনেজুয়েলায় নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু বিমান থেকে প্রহরীরা যখন তাদের চোখ বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নামায়, তখন তারা বুঝতে পারেন যে তাদের এল সালভাদোরে নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানালেন এডুয়ার হার্নান্ডেজ।

শিকল বাঁধা অবস্থায় তাদের যখন সিসোট কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের জবরদস্তি হাঁটু মুড়ে বসিয়ে মাথার চুল কামিয়ে দেওয়া হয়। এই অভিবাসীরা বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে তাদের নগ্ন করার পরে সাদা হাফপ্যান্ট, সাদা সোয়েটার আর সাদা রবারের জুতো পরতে হয়েছিল।

মার্ভিন ইয়ামার্তে প্রত্যর্পনের আগে পর্যন্ত টেক্সাসের একটি টরটিলা কারখানায় কাজ করতেন। তিনি বলছিলেন যে তাকে নগ্ন অবস্থায় মারধর করা হয়। “তারা আমার নিতম্বে লাঠি দিয়ে মারে, পাঁজরে ঘুসি মারে – তারা পোশাকও পরতে দেয়নি।

ভেনেজুয়েলার এই নাগরিকদের অভিযোগগুলি নিয়ে বারবার এল সালভাদোর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু কর্মকর্তারা কোনও জবাব দেয়নি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

জীবন্ত মানুষের কবর

Update Time : ০৭:৩১:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৫

আর্তুরো সুয়ারেজ বলছেন যে এল সালভাদোরের কুখ্যাত সিসোট কারাগারে তাকে আনার পরেই প্রহরীরা তাকে মারধর করে। জ্ঞান ফিরে আসার পরে তিনি খেয়াল করেন যে তার চশমাটা ভেঙে গেছে – সবকিছু ঝাপসা লাগছিল তার চোখে, তবে তাকে যেভাবে সম্ভাষণ করা হয়েছিল, সেটা তিনি স্পষ্টই শুনতে পেয়েছিলেন:

“জাহান্নামে স্বাগত। জীবিত মানুষের কবরস্থানে স্বাগত। কেবলমাত্র মৃত অবস্থাতেই এখান থেকে বেরতে পারবেন।”

অর্তুরো বলছেন, তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন যিনি, তিনি কারাগারের পরিচালক বেলার্মিনো গার্সিয়া।

সিসোট, বা ‘সেন্টার ফর দ্য কনফাইনমেন্ট অফ টেররিজম’ এল সালভাদোরের হিংস্রতম ও সবথেকে বিপজ্জনক গ্যাংস্টারদের গণহারে বন্দি করে রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। একের পর এক যেসব খুন ও চাঁদাবাজির ঘটনা দেশটিকে আতঙ্কিত করে রেখেছিল তা রোধ করতে প্রেসিডেন্ট নাঈব বুকেলে যে কঠোর পন্থা নিয়েছেন, তারই প্রতীক হয়ে উঠেছে এই বন্দিশালা।

২০২৩ সালে এই কারাগার চালু হওয়ার পর থেকে লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম এই বন্দিশালার ভিতরের অবস্থা সম্পর্কে কর্মকর্তারা কখনও মুখ খোলেন না। হাতে গোনা কয়েকজন বন্দি এই কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তাই কংক্রিটের প্রাচীর আর বিদ্যুতায়িত বেড়ার ভিতরে যে আসলে কী হয়, সে ব্যাপারে খুবই কম তথ্য পাওয়া যায়।

তবে আর্তুরোসহ আরও ২৫১ জন ভেনেজুয়েলার নাগরিককে সম্প্রতি সিসোট কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অভিবাসীদের গণহারে প্রত্যর্পন করাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে নীতি নিয়েছেন, তারই অধীনে এল সালভাদোর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে হওয়া এক চুক্তি অনুযায়ী এই বন্দিদের গত মার্চ মাসে সিসোট কারাগারে পাঠানো হয়।

গত মাসে ভেনেজুয়েলায় নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরেছেন এরা। তাদের ঘিরে একদিকে যেমন আনন্দোৎসব হয়েছে, তেমনই চোখের জলও ফেলেছেন অনেকে। কারাগারের ভিতরে কেমন ছিল তাদের জীবন, তা নিয়ে বিবিসি মুন্ডোর সঙ্গে কথা বলছেন মুক্তি পাওয়া আটজন। তারা জানিয়েছেন কীভাবে নিয়মিত তাদের মারধর করা হতো, কখন হাত বেঁধে লাঠি দিয়েও মারা হতো তাদের। একজন বলেছেন প্রহরীরা তাকে যৌন নির্যাতনও করেছে।

মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিরা বলেছেন কোনও চাদর বা তোষক ছাড়াই ধাতব বিছানায় তাদের শুতে হতো, খেতে হতো হাত দিয়ে। তাদের সঙ্গে বাইরের কোনও যোগাযোগ ছিল না, কোনও আইনজীবীও ছিল না তাদের। সময়ের হিসাবও রাখতে পারেননি তারা – কারণ কোনও ঘড়ি ছিল না সেখানে।

২৩ থেকে ৩৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রে বাস করতেন। এদের মধ্যে কেউ আমেরিকার আইন মেনে সেদেশে প্রবেশ করেছিলেন, কেউ আবার বেআইনি পথে গিয়েছিলেন সেখানে। তবে সবার বিরুদ্ধেই অভিযোগ করা হয়েছিল যে তারা এল সালভাদোরের সহিংস গোষ্ঠীগুলির সদস্য। তাদের সেকারণে প্রত্যর্পন করা হয়।

কোনও গ্যাং কিংবা অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগ অবশ্য তারা প্রত্যেকেই অস্বীকার করেছেন এবং এটাও বলেছেন যে তাদের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করার কোনও সুযোগই তারা পাননি। এদের বেশিরভাগই মনে করেন যে তাদের গায়ে নানা ধরনের ট্যাটু থাকার ফলেই তাদের চিহ্নিত করা হয়েছিল – কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দাবি করেন যে ওইসব ট্যাটুগুলি আসলে ভেনেজুয়েলায় গড়ে ওঠা একটা শক্তিশালী অপরাধ গোষ্ঠী ট্রেন দ্যে আরাগুয়া-র সঙ্গে যুক্ত থাকার চিহ্ন।

ভেনেজুয়েলার অভিবাসীদের ছবি: উপরের সারিতে - জোয়েন সুয়ারেজ, আর্তুরো সুয়ারেজ, উইলকেন ফ্লোরেজ, অ্যান্ড্রি হার্নান্দেজ। নিচের সারিতে - অ্যান্ডি পেরোজো, মার্ভিন ইয়ামার্তে, এডুয়ার হার্নান্দেজ, রিঙ্গো রিনকন
উপরের সারিতে – জোয়েন সুয়ারেজ, আর্তুরো সুয়ারেজ, উইলকেন ফ্লোরেজ, অ্যান্ড্রি হার্নান্দেজ। নিচের সারিতে – অ্যান্ডি পেরোজো, মার্ভিন ইয়ামার্তে, এডুয়ার হার্নান্দেজ, রিঙ্গো রিনকন

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বিতাড়িত অভিবাসীদের সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কী কী প্রমাণ ব্যবহার করা হয়েছে এই প্রশ্নের জবাব তারা দেয়নি।

পায়ের গোড়ালি আর হাতের কব্জি শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় তাদের বিমানে তোলার সময়ে ওই অভিবাসীদের ধারণা হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের ভেনেজুয়েলায় নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু বিমান থেকে প্রহরীরা যখন তাদের চোখ বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নামায়, তখন তারা বুঝতে পারেন যে তাদের এল সালভাদোরে নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানালেন এডুয়ার হার্নান্ডেজ।

শিকল বাঁধা অবস্থায় তাদের যখন সিসোট কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের জবরদস্তি হাঁটু মুড়ে বসিয়ে মাথার চুল কামিয়ে দেওয়া হয়। এই অভিবাসীরা বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে তাদের নগ্ন করার পরে সাদা হাফপ্যান্ট, সাদা সোয়েটার আর সাদা রবারের জুতো পরতে হয়েছিল।

মার্ভিন ইয়ামার্তে প্রত্যর্পনের আগে পর্যন্ত টেক্সাসের একটি টরটিলা কারখানায় কাজ করতেন। তিনি বলছিলেন যে তাকে নগ্ন অবস্থায় মারধর করা হয়। “তারা আমার নিতম্বে লাঠি দিয়ে মারে, পাঁজরে ঘুসি মারে – তারা পোশাকও পরতে দেয়নি।

ভেনেজুয়েলার এই নাগরিকদের অভিযোগগুলি নিয়ে বারবার এল সালভাদোর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু কর্মকর্তারা কোনও জবাব দেয়নি।