
বাংলাদেশের দুই রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণ অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে দুই দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। ঢাকার কাকরাইল এলাকায় এর জেরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জে আহত হয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন।
গুরুতর আহত নুরুল হক নুরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে, ঘটনাস্থলে 'মব ভায়োলেন্সের' মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা হয়েছে উল্লেখ করে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর – আইএসপিআর জানিয়েছে, "জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগে বাধ্য হয়"।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার কাকরাইলে এ ঘটনা ঘটে। দুটি রাজনৈতিক দলেরই কার্যালয় রয়েছে ওই এলাকায়।
দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে গণ অধিকার পরিষদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন বিবিসি বাংলাকে জানান, সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তারা।
"এ সময় আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা," অভিযোগ করেন তিনি।
সেখান থেকে ফিরে এসে আবার একটি মশাল মিছিল বের করে গণ অধিকার পরিষদ। সেই মিছিলেও হামলা হয়, বলে অভিযোগ করেন রাশেদ খাঁন।
অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারীর অভিযোগ, গণ অধিকার পরিষদের মিছিল থেকে তাদের নেতাকর্মীদের ওপর ইট-পাটকেল ছোঁড়া হয়।
"এতে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হন। তখন, আমাদের কর্মীরা তাদের পাল্টা ধাওয়া দেয়," অভিযোগ করেন তিনি।
ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী আসে। তারা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেয়।
তবে, এরপর গণ অধিকার পরিষদ মশাল মিছিল নিয়ে পার্টি অফিসে আগুন দিতে আসে বলে অভিযোগ করেন জাপা মহাসচিব।
যদিও গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁনের দাবি, তারা জাপা কার্যালয়ের দিকে যাননি। তারা কেবল রাস্তায় মিছিল করেছেন।
মশাল মিছিল বের হওয়ার পর আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ঘটনাস্থলে।
পুনরায় তাদের মশাল মিছিলে ওপর হামলার অভিযোগ করেন রাশেদ খাঁন। যদিও, মি. পাটোয়ারী বলছেন, তাদের নেতাকর্মীরা মশাল নিয়ে মিছিলকারীদের প্রতিরোধ করেছেন মাত্র।
"এরপর সেনাবাহিনী এসে এই মব ঠেকিয়ে দেয়," বলেন মি পাটোয়ারী।
ঘটনাস্থলে থাকা একজন সাংবাদিক ঝর্ণা রায় বিবিসি বাংলাকে জানান, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতেই ইট-পাটকেল নিক্ষেপ চলতে থাকে। পাল্টাপাল্টি ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় সংবাদকর্মীসহ অনেকে দুই পক্ষের মাঝে আটকা পড়েন। আহতও হন কেউ কেউ।
জাতীয় পার্টি ও গণ-অধিকার পরিষদ দুই পক্ষই দাবি করেছে তাদের ওপর আগে আক্রমণ করেছে অপরপক্ষ।
এরপর নিজেদের কার্যালয়ের সামনে একটি সংবাদ সম্মেলন শুরু করেন গণ অধিকার পরিষদের নেতারা।
সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদের ওপর ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ নেতা-কর্মীদের লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারছেন সেনা সদস্যরা।
তাকে বুট দিয়ে লাথি মারতেও দেখা যায়।
রাশেদ খাঁন বিবিসি বাংলাকে জানান, তাদের শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। মি খাঁন নিজেও ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল থেকেই বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলেন। তার অভিযোগ, এদিন জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ছিলেন।

আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তবে, সেখানে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় গণ অধিকার পরিষদের কর্মীদের।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও হাসপাতালে যান। বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার নিন্দা জানান তিনি।
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতিসহ অন্যদের ওপর হামলায় 'তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ' জানিয়েছে বিএনপি।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্ধৃত করে এক বিবৃতি বলা হয়েছে, "গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চাকে ব্যাহত করে এমন কোন কর্মকাণ্ডকে বিএনপি সমর্থন করে না এবং সুস্থধারার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হামলাকেও আমরা নিন্দা জানাই।"
এ ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। এছাড়া উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
নুুরুল হক নূরসহ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শনিবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে গণ অধিকার পরিষদ।
কাকরাইলের ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
যেখানে ঘটনাপ্রবাহ ও পরিস্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, "প্রথমে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবে একপর্যায়ে সংঘর্ষ বেড়ে গেলে তারা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা কামনা করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয় এবং এতে কয়েকজন সদস্য আহত হন।"
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, "ঘটনার শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উভয় পক্ষকে শান্ত থাকতে এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে স্থান ত্যাগ করার জন্য ও দেশের বিদ্যমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করার অনুরোধ জানায়।"
আইএসপিআর বলেছে, "তবে বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও কতিপয় নেতাকর্মীরা তা উপেক্ষা করে মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা করে। তারা সংগঠিতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং আনুমানিক রাত নয়টার দিকে মশাল মিছিলের মাধ্যমে সহিংসতা আরও বৃদ্ধি করে। এ সময় তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেওয়ারও চেষ্টা চালায়।
"এছাড়াও বিজয়নগর, নয়াপল্টন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সাধারণ জনগণের চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শান্তিপূর্ণ সমাধানের সকল চেষ্টা তারা অগ্রাহ্য করে। ফলস্বরূপ, জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগে বাধ্য হয়," উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম
উদ্ভূত ঘটনায় সেনাবাহিনীর পাঁচজন সদস্য আহত হয়েছে বলেও দাবি করেছে আইএসপিআর।
তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, "সকল ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারের এই সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করছে এবং জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা আনয়নে সকল ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে সদা প্রস্তুত রয়েছে। জননিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী সর্বদা বদ্ধপরিকর।"