নৌকা তৈরির কারিগরদের ঠক ঠক শব্দের কর্মযজ্ঞ চলছে। বাপ-দাদা হতে প্রাপ্ত এই শিল্পকে আঁকড়ে ধরে হাতের নিপুন ছোঁয়ায় শৈল্পিক সৌন্দর্যে তৈরি হয় এসব নৌকা। তালায় তৈরি হওয়া এসব নৌকার কদর রয়েছে ভোলা জেলাসহ পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে। নদীমাতৃক এই দেশে এক সময় যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হতো নৌকা। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া এই শিল্পকে কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে শতাধিক পরিবারের। বলছিলাম ভোলার লালমোহন উপজেলার গজারিয়া বাজার এলাকার নৌকা তৈরীর কর্মযজ্ঞের কথা।
জানা গেছে, ভোলার লালমোহন উপজেলার দক্ষিণ প্রান্ত এবং চরফ্যাশন উপজেলার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত চরউমেদ ইউনিয়ন। লালমোহন উপজেলার বৃহত্তম কয়েকটি বাজারের একটি গজারিয়া। আর এই গজারিয়া বাজারটি পুরো ভোলা জেলাসহ পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে প্রসিদ্ধ নৌকা তৈরির কারখানার জন্য। চরফ্যাশন-ভোলা আঞ্চলিক মহাসড়কের কোল ঘেঁষে লালমোহন উপজেলার গজারিয়া বাজার এলাকার গড়ে উঠেছে নৌকা গড়ার কারখানা। প্রতি বছর মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার অন্যতম উপকরণ নৌকা থাকার কারণে সারা বছর নৌকা তৈরির কাজ করতে হয় কারিগরদের। নৌকার তৈরির কারিগররা সাধারণত ডিঙ্গি ও কোষা ২ ধরনের নৌকা তৈরি করে থাকেন। কোষা ৯-১০ ফুট আর ডিঙি নৌকা ১৫-১৬ ফুট দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে। কাঠসহ প্রয়োজনীয় মালামাল প্রস্তুত থাকলে দৈনিক ২টি থেকে ৩টি নৌকা তৈরি করা সম্ভব হয়। তবে এখানে সবচাইতে কোষা নৌকার কদর বেশি রয়েছে বলে জানান বিক্রেতারা।
সাধারণত নৌকা তৈরিতে খৈ, কড়ই ও চম্বল, সুন্দরী গাছের কাঠ, ধাতু দ্রব্য পেরেক, তারকাটা, জলুয়া ব্যাবহার হয়ে থাকে। তাছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেহগনি গাছের কাঠ ব্যাবহার করে থাকেন কারিগররা। একটি ১২ হাত লম্বা একটি নৌকা তৈরি করতে ৩ জন শ্রমিক এর মজুরী প্রায় ৩/৪ হাজার টাকা। এবং কাঠ বাবদ খরচ হয় ৪ হাজার টাকা। নানা বিধি আনুষঙ্গিক উপকরণ বাদে খরচ হয় ৩ হাজার টাকা। ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করে একটা নৌকা বিক্রি হয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। নৌকা ব্যাপারীরা জানান, প্রতিদিন সকল খরচ মিটিয়ে সামান্য কিছু টাকা লাভ হয় আমাদের। তারপরেও ৩০-৪০ বছর ধরে চলে আসা এই শিল্পকে আমরা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।
যারা নৌকা তৈরির করে জেলেদের কাছে বিক্রি করেন, তাদেরকে ব্যাপারী বলা হয়। আর প্রসিদ্ধ নৌকা তৈরি বাজার গজারিয়ায় রয়েছে এরকম ১৫ জন ব্যাপারী। তাদের মধ্যে শেখ ফরিদ, আমির হোসেন, মামুন হোসেন, মো: নাগর, মো: কালাম, আলমগীর হোসেন, বেল্লাল হোসেন, মো: হাসান, মিলন, আল-আমীন, শানু, ইকবাল হোসেন, জুয়েল তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যাপারী। সবাই স্বাবলম্বী নৌকা তৈরি ও বিক্রি করে। নিজের সন্তান, পরিবার ও পরিজন নিয়ে ভালোই কাটছে তাদের দিনকাল এমনটাই জানালেন কয়েকজন ব্যাপারী।
এদিকে শ্রমিকরা জানান, আকার ও আয়তনভেদে একেকটি নৌকা তৈরিতে সময় ও উপকরণের প্রয়োজন আলাদা। কোনো নৌকা তৈরি করতে ১ সপ্তাহ, আবার কোনোটা ১৫-২০ দিনও লাগে। পুরো কাজ হয় দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে। গজারিয়া কাঠপট্টিতে প্রায় ১০টি টিম্বার ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা মিস্ত্রিদের নিয়োগ দেন। যে নৌকা ১ লাখ টাকায় বিক্রি হয়, তাতে লাভ হয় প্রায় ২০ হাজার টাকা। আর বড় ধরনের ট্রলার বা ফিশিং বোট যা ৫-৬ লাখ টাকায় বিক্রি হয়, তাতে লাভ থাকে ৫০ হাজার টাকা মতো। মিস্ত্রি ও কাঠসহ নৌকা তৈরির উপকরণের পেছনে প্রতিটি টিম্বারে রয়েছে লাখ লাখ টাকার পুঁজি, যার বেশিরভাগই এনজিও ঋণ সহায়তায় এসেছে।
নৌকা তৈরির কারিগর মনির উদ্দিন বলেন, আমি অনেক বছর ধরে নৌকা তৈরি করছি। আগে মজুরি কম ছিল, এখন দৈনিক পাই ৯০০ টাকা করে। সোহাগ মিস্ত্রি বলেন, লালমোহনসহ আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন নৌকা কিনতে আসে। এখানেই তৈরি হয়, এখান থেকেই বিক্রি হয়। ছোট আকারের নৌকা গড়ে ৩০-৮০ হাজার টাকা এবং বড় আকারেরগুলো ৫০ হাজার থেকে ৬/৭ লাখ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। ফরিদ মিস্ত্রি বলেন, ভালো মানের কাঠ দিয়ে তৈরি নৌকা ১০-১২ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। এখানকার নৌকার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে জেলার বাইরেও।
আলমগীর ব্যাপারী জানান, নৌকা তৈরি কারখনায় সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করে শ্রমিকরা। তৈরি করা নৌকা জেলেরা নিয়ে যান কিনে। তিনি আরও বলেন, আমাদের সরকারিভাবে কেনো আর্থিক সহায়তা করা হয়নি। সরকারি ভাবে আর্থিক সহায়তা পেলে পেশাটি আরও উন্নতি করতে সচেষ্ট হবেন তারা।
মো: মামুন ব্যাপারী বলেন, তিনি নৌকা তৈরির ব্যবসার সাথে জড়িত। তার কারখানায় ৪ জন মিস্তরি কাজ করে। ভোলা জেলার চরফ্যাশন, দক্ষিণ আইচা, শশীভূষণ, দুলারহাট থানা, মনপুরা উপজেলাসহ জেলার পাশ্ববর্তী জেলা ও উপজেলা থেকে জেলেরা এখানে নৌকা কিনতে আসো। তাদের চাহিদা মত নৌকা আমরা তৈরি করে দেই। তৈরি করা নৌকা বিক্রি করে আলহামদুলিল্লাহ ভালো লাভ হচ্ছে।
গজারিয়া মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক মোশাররফ হোসেন বলেন, আমার বাসা নৌকা তৈরি কারখানার পাশে। প্রায় ৪০ বছর ধরে নৌকা তৈরি শিল্পটি চলে আসছে। এই পেশার সাথে শতাধিক লোক জড়িত। তারা এই কর্ম করে নিজেরা ভালো ভাবে পরিবার ও পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। যদি সরকারিভাবে নৌকা তৈরি কারখানায় কর্মরতদের আর্থিক সহায়তা করা হয় তাহলে দেশের অর্থনীতিতে তারা আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে।
লালমোহন প্রেসক্লাবের সিনিয়র সদস্য সাংবাদিক আজিম উদ্দিন খাঁন বলেন, আমরা ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি গজারিয়া বাজার সংলগ্ন এলাকায় নৌকা তৈরির কারখানা গড়ে উঠছে। পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত এই কারখানাটি তিনি ধরে রেখেছেন। বারো মাস নৌকা তৈরি করা হয়। তার কারখানায় প্রায় শতাধিক শ্রমিক কাজ করেন। তবে নৌকা তৈরির সরঞ্জামের দাম ঊর্ধ্বগতির পরও তিনি এক যুগের বেশি সময় ধরে এই নৌ-শিল্প ধরে রেখেছেন। এখন এই নৌ-শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তার বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আলী আহমদ আকন্দ বলেন, এই সম্ভাবনাময় নৌকা শিল্পের আরও প্রসার ঘটানোর জন্য যা যা প্রয়োজন, সেটি আমরা অবশ্যই করবো।