ঢাকা: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও তার স্ত্রী শাহিদ সিদ্দিকের দেশেই বাগানবাড়ি, ফ্ল্যাট ও বিপুল জমির খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, অনুসন্ধান এখনো চলছে। আরও সম্পদ পাওয়া যাবে বলে ধারণা করছেন তারা। ব্যাংকে তারিক সিদ্দিক ও তার স্ত্রীর টাকা আছে কি না, কত লেনদেন হয়েছে, সেই তথ্য পাওয়া এখনো বাকি।দুদকের নথি অনুযায়ী, তারিক সিদ্দিকের নামে গাজীপুরে বাগানবাড়ি আছে দুটি। ঢাকার গুলশানে রয়েছে একটি সাততলা বাড়ি। বারিধারায় রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট ও একটি ফ্ল্যাটের একাংশ। গাজীপুরে আরেকটি সাততলা বাড়ির চার ভাগের এক ভাগের মালিকানা তারেক সিদ্দিকের নামে। এর বাইরে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে তারিক সিদ্দিক ও তার স্ত্রীর নামে প্রায় ৪৮ বিঘা জমি রয়েছে। এ ছাড়াও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় একাধিক প্লট রয়েছে তার ও তার স্ত্রীর।
বাগানবাড়ি, জমি ও ফ্ল্যাট মিলিয়ে তারিক সিদ্দিকের সম্পদের দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ৩৮ কোটি টাকার বেশি। যদিও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সেখানে যে দামে সম্পদের দলিল দেখানো হয়েছে, বাজারমূল্য তার কয়েক গুণ।
দুদক জানিয়েছে, তারা ২৪ বিঘা জমি এবং ৪টি ফ্ল্যাট ও ১টি ফ্ল্যাটের একাংশ আদালতের আদেশে জব্দ করেছে। বাকি সম্পদও জব্দের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশে তারিক সিদ্দিকের সম্পদ আছে কি না, তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনার পরিবারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক একটি আলাদা দল করেছে। সেই দলের সদস্যরা এই অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, তারেক সিদ্দিক, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে প্রায় শতকোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তার বিদেশে সম্পদ রয়েছে কি না, সেই তথ্য জানতে বিএফআইইউকে (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তারিক সিদ্দিক ও তার পরিবারের সদস্যরা। ধারণা করা হয়, তারা দেশ ছেড়েছেন। তারিক সিদ্দিকের বিরুদ্ধে জুলাই হত্যাকাণ্ড ও শেখ হাসিনার আমলে গুমের ঘটনায় মামলা এবং দুর্নীতির একাধিক মামলা রয়েছে। মামলাগুলোতে তাদের নিয়োগ করা কোনো আইনজীবীর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ফলে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সম্পর্কে তারেক সিদ্দিক বা তার স্ত্রীর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
শেখ হাসিনার শাসনামলে খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন তারেক সিদ্দিক। তিনি শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার দেবর। গাজীপুর মহানগরের ফাওকাল এলাকায় তারিক সিদ্দিকের বাগানবাড়ির ভেতরে আছে ডুপ্লেক্স ভবন, শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর ও গাছপালা। নথিপত্রে বাড়িটিতে জমির পরিমাণ ১৭৮ শতাংশ বা ৫ দশমিক ৪ বিঘা। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, জমির পরিমাণ অন্তত চার গুণ।
মহানগরীর বাঙ্গালগাছ এলাকায় ‘বাগানবিলাস’ নামে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের আরেকটি বাগানবাড়ির ভেতরে একটি দোতলা ভবন, একটি ছোট ঘর, সামনে বড় একটি পুকুর এবং পাশের বিল ও পুকুর দেখার জন্য ‘ওয়াচ টাওয়ার’ রয়েছে। ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড়ির ৭৮ শতক (২ দশমিক ৩৬ বিঘা) জমির নামজারি হয়েছে তারিক সিদ্দিকের নামে। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বাড়ির সীমানার মধ্যে জমির পরিমাণ অন্তত ১০ গুণ হবে।
দুদকের নথি পর্যালোচনা করে জানা গেছে, বাগানবাড়ি বাদেই তারিক সিদ্দিক ও তার স্ত্রীর প্রায় ৪৮ বিঘা জমির মধ্যে ৩ বিঘা গাজীপুরে।দুদক সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জে তারিক সিদ্দিকের জমি মূলত রূপগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নের তিনটি মৌজায়। ২০২৩ সালে তিনি হিরুনাল মৌজায় ১০০ শতাংশ জমি কেনেন। তিনি স্থাপনাহীন বাড়ির এই জমির দলিলমূল্য দেখিয়েছেন ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। রূপগঞ্জে জমি কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, ১০০ শতাংশ জমির দাম কম করে হলেও ৫০ কোটি টাকা হবে।
জমির দলিলের তথ্য পর্যালোচনা করে দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গাজীপুরের দাউদপুরের হিরুনাল মৌজায় তারিক আহমেদ ও তাঁর স্ত্রীর নামে একসঙ্গে ২৪ বিঘা জমি রয়েছে। এই জমি তিনি একটি আবাসন কোম্পানির সঙ্গে বদল করেছেন। দুদকের কর্মকর্তারা বলেন, এই ২৪ বিঘা জমি বদলের ঘটনাটি বেশ রহস্যজনক। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, তারিক আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী নিজেদের নামে কেনা জমি আবাসন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তাদের কাছ থেকে এই পরিমাণ বদল করে নেন। কিন্তু দুই জমির দামে পার্থক্য অনেক।
অন্যদিকে দুদকের নথি বলছে, তারিক সিদ্দিক ও তার স্ত্রী বেশির ভাগ সম্পদ কিনেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের মেয়াদে অবারিত চোরচন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ জড়িতদের পাশাপাশি যোগসাজশকারীদেরও দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে এমন অনাচারের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হয়।