
বাজারে ব্রয়লার মুরগির দরপতনে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন প্রান্তিক খামারিরা। এর ফলে খামার পরিচালনায় আগ্রহ হারিয়েছেন অধিকাংশ প্রান্তিক খামারি। ফলে চাহিদায় তীব্র ভাটা পড়েছে ব্রয়লার মুরগির এক দিন বয়সী বাচ্চার। এতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে কমেছে বাচ্চার ও মুরগির দাম।
জানা যায়, খামারি পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ কেজি প্রতি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা হলেও চলতি মে মাসে থেকে খামারিরা প্রতি কেজিতে পেয়েছেন ১২০ টাকার নিচে। আজ বুধবার (৪ জুন )উপজেলার আরমবাড়িয়া বাজারে বয়লার মুরগি বিক্রেতারা মাইকিং করে কেজি ১২৫ টাকা খুচরা দরে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেও কাঙ্খিত ক্রেতা মেলাতে পারেননি। এই বাজারের মুরগি বিক্রেতারা জানান, মুরগির খামার থেকে তারা ১১৫ টাকা কেজি দরে ব্রয়লার মুরগি কিনেছেন।
প্রান্তিক খামারি ও বিক্রেতারা আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলছেন, উৎপাদন খরচের তুলনায় ব্রয়লার মুরগির দাম কমা অব্যাহত থাকলে প্রান্তিক খামারিদের ও লোকসানের কারণে খামার বন্ধ হয়ে যাবে। পোলট্রি শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে । তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, যে হারে খামারিরা পোলট্রি ব্যবসা ছাড়ছেন তা অব্যাহত থাকলে অধিকাংশ পল্টি খামার বন্ধ হয়ে যাবে ।
বুধবার (৪ জুন ) ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার খামারগুলো সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগির চলমান বাজার দরে খামারিরা হতাশ। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে তাদের পক্ষে এ ব্যবসায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে বলেও মন্তব্য করেছেন। উপজেলার আরামবাড়ী এলাকার প্রায় ২০ বছর ধরে পোল্টির খামার করে অভিজ্ঞ খামারি সালাউদ্দিন জানান, তার পাঁচটা মুরগী শেড রয়েছে।এতে প্রতি চালানে ১৫ হাজার মুরগি হয়। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে বয়লার মুরগির খামার ব্যবসায় ধস নেমেছে । খরচ বৃদ্ধি ও দরপতনসহ নানা কারণে চলতি বছরেখামার চালাতে গিয়ে তার তার প্রায় ১০ লক্ষ টাকা লোকশান হয়েছে।
এখন খামার বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। রোজার ঈদের পর থেকে অনেকে খামার করায় আগ্রহ হারিয়েছেন । অনেক খামারি তাদের শেডে বাচ্চা তুলছেন না। তিনি ব্যক্তিগত খামারের হিসাব দিয়ে বলেন, প্রতিটা একদিনের বাচ্চা ৩০ টাকা দরে কেনা বাচ্চায় কেজি ১৪০ টাকা উৎপাদন খরচের মুরগি কেজি ১১৫ টাকা থেকে ১১৮ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। মুলাডুলি এলাকার খামারি মাহবুল জানান, তার সেটে প্রতিবারে ৫ থেকে ৭ হাজার মুরগি হয়। এতে করে গত এক ব্যাচে ৬০ হাজার টাকা লোকসান দিতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাচ্চার দাম সীমাহীন ভাবে কমলেও বিক্রির সময় বেশি লোকসানের ভয়ে দুটি শেডের একটি বন্ধ রেখেছি।
একই এলাকার তরুণ খামারি সাদ্দাম হোসেনের তিনটি শেডে সাড়ে ৬ হাজার মুরগি পালন ক্ষমতা থাকলেও মাত্র একটিতে ১ হাজার ২০০ ব্রয়লার তুলেছেন তিনি। তিনি জানান, ২৬ দিন আগে ২৭ টাকা দরে কেনা বাচ্চা পালন করেও নিশ্চিত লোকসানের ভয়ে রয়েছি । কোরবানির ঈদের পরও এ বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ বলে উল্লেখ করেন তিনি। সরেজমিন পরিদর্শনকালে অন্য খামারিদেরও একই ধরনের কথা বলতে শোনা গেছে।
এ প্রসঙ্গে কাজী ফার্মাসের ঈশ্বরদী উপজেলা প্রতিনিধি ডা: মাহাবুল বলেন, এক দিনের বাচ্চার দাম ব্রয়লার মুরগির দামের ওপর নির্ভর করে । ব্রয়লার মুরগির বাজার দর কম থাকলে খামারিরা বাচ্চা কিনতে চান না, তাই বাচ্চা মুরগির দামও কমে যায়। যখন ব্রয়লারের দাম বেশি থাকে, তখন সকল খামারিই বাচ্চা কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, ফলে উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যায় এবং বাচ্চার দামও বৃদ্ধি পায়।
চাহিদার তুলনায় বয়লারের উৎপাদন অনেক বেশি হওয়ায় এখন বাজারে ব্রয়লারের দাম কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন প্রতিটা এক দিনের বাচ্চা ২০ টাকা দরে খামারিদের কাছে বিক্রি করছেন। তিনি জানান, তিনি ঈশ্বরদী উপজেলায় ৩৭ টি খামারে প্রায় ৩০ হাজার বাচ্চা সরবরাহ করেন। চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে দাম নির্ধয়ে থাকে।
ঈশ্বরদী উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানা গেছে, গত করোনার সময় লোকসানে উপজেলার অনেক খামার বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আবার নতুন করে খামারিরা খামার চালু করতে থাকে। বর্তমানে ঈশ্বরদী উপজেলায় ৩১০ টি লেয়ার ও বয়লার মুরগির খামার রয়েছে। প্রতিটি খামারে এক হাজার থেকে ১০ হাজার মুরগি ধারণের শেড রয়েছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার আকলিমা খাতুন বলেন, খামারিরা যাতে লোকসানের মুখে পড়তে না হয় তার জন্য তারা তাদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেরই এ সময় কোরবানি থাকায় তারা কোরবানির ঈদের আগে বয়লার মুরগি কেনছেন না বলে তার ধারণা। তাই চাহিদা চাইতে যোগান বেশি হওয়ায় বয়লার মুরগির দর পতন হতে পারে। সরকার অবশ্য সদ্য ঘোষিত বাজেটে পল্টি ও পশু খাদ্য সয়াবিন ভুট্টা সহ পশু খাদ্যের আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করেছেন। এতে খাদ্যের দাম কিছুটা কমতে পারে। খামারিরাও লাভবান হবেন।
এ ব্যাপারে পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার এ,কে,এস,এম,মুশাররফ হোসেন বলেন,পোল্ট্রি খামারিদের খাবারের উপরে বেশি খরচ হয়। সরকার যদি কৃষি খাতের মতো পোল্ট্রি খামারিদের ঔষধ,খাদ্যের উপর ভর্তুকি দেয়া,তাহলে খামারিরাও লাভবান হবেন। তিনি আরো বলেন, জেলেদেরও মাছ মারা নিষেধের সময় খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। অথচ মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্তের পারিবারিকভাবে ও আত্মীয়স্বজন এলে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে বয়লার মুরগি। তাই পল্টি ও পশু খাতের খাদ্যে ভর্তুকির আওতায় আনতে হবে।
আলমাস আলী, ঈশ্বরদী (পাবনা ) প্রতিবেদক 



















