বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যদি পদত্যাগ করেন, এরপর আইনি জটিলতা কী হতে পারে, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
আইনগত দিক থেকে অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠনের সুযোগ কতটা আছে, সরকার পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আইনি কোনো বাধা আছে কিনা, এসব প্রশ্ন উঠছে ।
প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনা নিয়ে আলোচনার শুরু জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের দেওয়া বক্তব্যের মাধ্যমে।
নাহিদ ইসলাম বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, তিনি ওইদিন সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে পারেন, এমন খবর পেয়েই তার সঙ্গে দেখা করেছেন উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা "পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন"।
[caption id="attachment_3713" align="aligncenter" width="300"]
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস[/caption]
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুনর্গঠনের সুযোগ আইনে কতটা আছে, এই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন আইনজীবীরা।
আইনজীবীদের কেউ কেউ বলছেন, সুপ্রিমকোর্টের মতামত নিয়ে দলগুলোর সমর্থনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। ফলে এখন অধ্যাপক ইউনূস পদত্যাগ করলে কোনো সাংবিধানিক সংকট হবে না; তখন নতুন সরকার গঠনের প্রশ্ন আসবে।
তাদের ব্যখ্যা হচ্ছে, অধ্যাপক ইউনূস চলে গেলে রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে দিতে পারেন, যে সরকার শুধু নির্বাচন করবে।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক পরিস্থিতিটাকে ব্যাখ্যা করেন ভিন্নভাবে। তিনি বলেন, আইনে কী বলা আছে, তা এখন ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। কারণ "আইন অনুযায়ী কিছু হচ্ছে না।"
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত বছরের ডিসেম্বরে পঞ্চদশ সংশোধনীর আংশিক বাতিল করেছে হাইকোর্ট। যে অংশটি বাতিল করা হয়েছে তার ফলে দেশের সংবিধানে আবারো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার পথ তৈরি হয়েছে।
শাহদীন মালিক বলছেন, অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে না এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর আংশিক বাতিল করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর সুযোগ করা হলো, এই সংশোধনী করার ক্ষমতা তো সংসদ ছাড়া কারো নাই।
"তাই, এখন জোড়াতালি দিয়ে চলতে হবে। এখন আর আইনের ভূমিকা নাই। আইন অনুযায়ী কিছু হচ্ছে না। সব আইনের বাইরে হচ্ছে। আইনের প্রশ্ন এখন অবান্তর," বলে মন্তব্য করেন তিনি।
[caption id="attachment_3714" align="aligncenter" width="300"]
আটই অগাস্ট শপথ নেন অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার[/caption]
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পর আটই অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা শপথ নেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চেয়ে রেফারেন্স পাঠান।
তখন আদালত উপদেষ্টাদের শপথ পাঠ করানোর অনুমতি দেয়। শাহদীন মালিক বলেছেন, "রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে সংবিধানের বাইরে গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। কিন্তু আপিল বিভাগের বড় দুই রায়ে বলা আছে— এটি করা যায় না। কোনো কিছুর দোহাই দিয়ে যা অসাংবিধানিক, তাকে সাংবিধানিক বলা যাবে না।"
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদও মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে আ'লীগ সরকারের পতনের পর একটি "শূন্যতা" তৈরি হয়েছিলো।
"তখন প্রয়োজনের তাগিদে একটি সরকার গঠন করা হয়েছে এবং সরকারের বৈধতা নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি করে নাই, এটির আইনগত প্রশ্নও তখন উত্থাপন হয় নাই" বলে মনে করেন তিনি।
তবে মুহাম্মদ ইউনূস যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে "কোনো সাংবিধানিক সংকট হবে না" উল্লেখ করে মনজিল মোরসেদ বলেন, "উনি পদত্যাগ করলে নতুন সরকার গঠনের প্রশ্ন আসবে। উনি যদি থাকেনও, নির্বাচন করতে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম দিয়ে সরকার গঠন করা যাবে।"
[caption id="attachment_3715" align="aligncenter" width="300"]
উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েএনসিপির হাল ধরেছেন নাহিদ ইসলাম। ফাইল ছবি[/caption]
আইনজীবী মনজিল মোরসেদের মতে, গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজন ছিল। এখন তা নাই। এখন নির্বাচন দরকার। তাই, নির্বাচন যদি 'নেসেসিটি' হয়, তাহলে নতুন করে আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দরকার নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করলেই হবে।
তিনি পঞ্চদশ সংশোধনীর আংশিক বাতিলের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, "নির্বাচন দিতে গেলে এই সরকারের আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকার সুযোগ নাই।"
"তাদেরকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। কারণ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়েআনার সুযোগ রাখা হয়েছে। আইনে এভাবেই আছে যে, নির্বাচন করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার" বলেন মনজিল মোরসেদ।
এই আইনজীবীর মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বর্তমানে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদও থাকতে পারে। আবার, রাষ্ট্রপতির মনোনয়নক্রমে নতুন করেও পরিষদ সাজানো যেতে পারে।
নিয়ম অনুযায়ী, নির্বাচনের অন্তত ৯০ দিন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় আদালত থেকে রেফারেন্স আনা হয়েছিলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ওই রেফারেন্সের প্রয়োজন নেই বলেও মনে করেন মনজিল মোরসেদ।
তবে মুহাম্মদ ইউনূস যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে তার উপদেষ্টা পরিষদ কি বহাল থাকবে?
জবাবে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, "ওনাদেরকে প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত করেছেন যে আমার সাথে কাজ করেন। উনি না থাকলে অন্যদেরও থাকার সুযোগ নাই।"
একইসঙ্গে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান যদি অন্য উপদেষ্টাদের রাখতে চান, রাখতে পারেন।
আইনজীবী শাহদীন মালিকও বলেছিলেন, "ইচ্ছামতো করলে তো যা ইচ্ছা তা করা যায়।"
তবে তিনি মনে করেন, মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করলে পরবর্তী সরকার প্রধান নির্বাচনের জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে একজন ব্যক্তির ব্যাপারে ঐকমত্যে যেতে হবে।
[caption id="attachment_3716" align="aligncenter" width="300"]
সরকার গঠনের আগে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস (মাঝে) দেশে ফিরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সাথে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছিলেন[/caption]
ঠিক কী কারণে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে চাইছেন, এর ব্যাখ্যা সরকারের কেউ দেয়নি। তবে এনসিপি'র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্য থেকে এ বিষয়ক ধারণা পাওয়া যায়।
তিনি মুহাম্মদ ইউনূসের বরাতে বৃহস্পতিবার রাতে গণমাধমে বলেছেন– প্রধান উপদেষ্টা দেশের চলমান পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারবেন না, এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
"আমিতো এভাবে কাজ করতে পারবো না। তো রাজনৈতিক দলগুলা তোমরা সবাই একটা জায়গায়, কমন জায়গায় না পৌঁছাতে পারো," বলেন নাহিদ ইসলাম।
নাহিদ ইসলামের বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, প্রধান উপদেষ্টা মনে করছেন, বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতায় তিনি আসলে কাজ করতে পারছেন না। তাই, পদত্যাগের কথা ভাবছেন।
পদত্যাগ সংক্রান্ত ইস্যুতে এখন পর্যন্ত সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে কেউ কোনও মন্তব্য করেননি। তবে অধ্যাপক ইউনূস ঢাকাসহ সারাদেশে চলমান একের পর আন্দোলনের কারণে সরকার যে বেকায়দায়, পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্যে তা স্পষ্ট।
তিনি গত শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে বলেন, "আমাদের তিনটা দায়িত্ব; সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। শুধুমাত্র নির্বাচন করার জন্য আমরা দায়িত্ব নেইনি।"
"তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে যার যতো রকম দাবি আছে সব দাবি নিয়ে রাস্তায় বসে রাস্তা আটকে দিচ্ছে, শহর অচল করে ফেলছে" বলে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন। বিবিসি