ঢাকা ০৭:৪২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo স্কয়ার ফার্মারর বিরুদ্ধে ডোজ প্রতারণা ও রিপ্যাকিংয়ের অভিযোগে প্রেস কনফারেন্স শনিবার Logo ৫৭ বছরেও শেবাচিমে চালু হয়নি নিউরো ওয়ার্ড, স্ট্রোকের রোগীদের চরম ভোগান্তি Logo সৈয়দপুরে আর্মি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক হিসাববিজ্ঞান দিবস পালিত Logo তানোরে নতুন ধানের জাত ব্রি ধান ১০৩ এর মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত Logo প্রিপেইড মিটার স্থাপন বন্ধ ও মামলা প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন দাবিতে মৌন মিছিল ও স্মারকলিপি হস্তান্তর Logo সৈয়দপুরে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার Logo শ্রীমঙ্গলে সাংবাদিকদের সাথে সংসদ সদস্য প্রার্থী হারুনুর রশিদের মতবিনিময় সভা Logo মোবাইল-ই কাল হলো নবম শ্রেণীর ছাত্রী জ্যামির, শিক্ষকের শাসন -অতঃপর বিষপানের মৃত্যু Logo রাজধানীর বাড্ডা ও শাহজাদপুরে ২ বাসে আগুন Logo রাজধানীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে একজন নিহত

‘আওয়ামী ও মঙ্গলমুক্ত’ বর্ষণবরণ শোভাযাত্রা!

বাংলা নববর্ষ বরণের সবচেয়ে বড় আয়োজন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ নাম বদলে হলো ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’৷ আয়োজকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে একে আওয়ামী মুক্ত করা হয়েছে৷ তবে অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ধান্তের পেছনে ধর্মীয় বিবেচনা রয়েছে৷

মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুক্রবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন নাম পরিবর্তনের৷ এ সময় তারা এর কারণ হিসেবে একে আওয়ামীমুক্তকরণের কথা বলেছেন৷

নাম বদলের কারণ যা বলা হলো

শুক্রবার চারুকলা অনুষদে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম এবারের শোভাযাত্রার নাম ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ ঘোষণা করেন৷ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আগেও পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রাটি হত, তার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’৷ সেটি পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল৷ আমরা আবার ‘আনন্দ শোভাযাত্রায়’ ফিরে গেলাম৷ এটাকে পুনরুদ্ধার বলা যেতে পারে৷”

শুক্রবার সন্ধ্যায় অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯৯০ সালে যখন আনন্দ শোভাযাত্রা নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয় তখন এর ভিতরে রাজনীতি ছিলো৷ এখন নাম পুনরুদ্ধার করে আওয়ামীমুক্ত করা হলো৷”

এর আগে একই সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেছেন, ‘‘আমরা নাম পরিবর্তন করছি না৷ আমরা পুরোনো নাম এবং ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি, যেটা দিয়ে চারুকলার এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল৷”

অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘‘আনন্দ শোভাযাত্রা নাম ছিলো৷ পরের বছর এই নাম যখন ওয়াহিদুল হকের প্রস্তাবে  মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয় তখন এরমধ্যে একটা রাজনীতি ছিলো৷ এটাকে রাজনৈতিক করা হয়েছে৷ সার্বজনীন আর ছিলোনা৷ ওই সময় তো আমিও ছিলাম৷ আওয়ামী লীগের লোকজন এটাকে দখল করে নিয়েছিলো৷ তারা তাদের লোকজনকে এরমধ্যে ঢুকিয়েছে৷”

‘‘আসলে আনন্দ আর মঙ্গল শব্দ নিয়ে কোনো সমস্যা নয়৷ ওই দুইটি শব্দের অর্থ নিয়েও কোনো সমস্যা নেই৷ সমস্যা রাজনীতি নিয়ে৷ আওয়ামী লীগের লোকজন রাজনীতি ঢুকিয়ে এটা সবার না করে তাদের দলীয় অনুষ্ঠানে পরিণত করেছিল৷ সেটা দূর করা হলো,” বলেন তিনি৷

নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে  পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা আওয়ামী দলখমুক্ত হলো কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ , অনেকটাই দখলমুক্ত হলো৷”

কীভাবে এলো মঙ্গল শোভাযাত্রা

যারা ঐহিত্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু করেছিলেন তারা বলছেন, আসলে পর্যায়ক্রমে এই আয়োজনের নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়৷ এটা মোটেই চাপিয়ে দেয়া হয়নি৷

বাংলা নর্ববর্ষে প্রথম শোভাযাত্রা হয় ১৯৮৫ সালে যশোরে৷ এর আয়োজক ছিলো যশোরের চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট৷ তার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মাহবুব জামিল শামীম৷ তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে যশোরে এর নাম ছিলো বর্ষবরণ শোভাযাত্রা৷ পরের বছর এটা ময়মসিংহে হয়৷  পরে ঢাকার চারুকলায় ১৯৮৯ সালে এটা আনন্দ শোভাযাত্রা নামে শুরু করি৷ ১৯৯০ সালে এর নাম দেয়া হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা৷”

মাহবুব জামিল শামীম আরো বলেন, নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’৷

‘‘তখনও আমি চারুকলার মাস্টার্সের ছাত্র৷ সিনিয়ররা বললেন, বাংলা বছরের প্রথম দিনে আমরা সবার মঙ্গল কামনা করতে চাই ,” জানান তিনি৷

তার কথা, ‘‘২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির মত আমরা একটি সার্বজনীন আয়োজন চেয়েছিলাম৷ আর সেটাই ১৯৯০ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম নিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ এই নামটি সবাই গ্রহণ করছেন৷ এখন কেন নাম পরিবর্তন করা হলো তা যারা করেছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন৷ আমার কোনো মন্তব্য নাই৷ তবে তখনো নববর্ষের এই বাঙালি সংস্কৃতির আয়োজনকে মেনে নিতে পারতনা কেউ কেউ৷ নানা কথা বলত৷ মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সমালোচনা করত৷ তবে তখন তারা সংখ্যায় কম ছিলো৷”

যশোরের ওই বাংলা বর্ষবরণ শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের আরেকজন চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বর্তমান সভাপতি হারুন-অর-রশীদ  বলেন, ‘‘শুরুতে আমরা একাধিক নামে করেছি৷ ঢাকায় নিয়ে আসার পর মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটি সর্বসম্মতভাবেই  গ্রহণ করা হয়৷ আমাদেরও মনে হয়েছে ওই নামটি সার্বজনীন৷ কারণ বছরের শুরুতে মঙ্গল কামনার জন্যই আমাদের আয়োজন৷”

মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই পরিবর্তনের পেছনে ধর্মীয় রাজনীতি দেখছেন কেউ কেউ৷

চারুকলার সাবেক ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘আসলে যারা এই পরিবর্তন করেছেন তারা বাঙালি সংস্কৃতি কখনো মানতে পারেননি৷  তারা বাঙালি সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি মনে করেন৷ সুযোগ বুঝে তাই নাম পরিবর্তন করে ফেলেছেন৷”

আর অতীতের মত এবারও ইসলামি দল ও সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান প্রকাশ করে  আসছিলো৷

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে ও ধারণায়’ কিছু করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম৷

তিনি বলেছেন, ‘‘নববর্ষের দিন মানুষ শালীনতা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সমর্থিত পন্থায় নানা আয়োজন করতেই পারে৷ কিন্তু সেই দিন কোনো যাত্রা করলে তাতে মঙ্গল হবে- এমন বিশ্বাস করলে বা ধারণা করলে পরিষ্কারভাবে তা গুনাহের দিকে নিয়ে যাবে৷ তাই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে কোনো কিছু অবশ্যই করা যাবে না৷ ‘মঙ্গল শব্দ ও ধারণা’ অবশ্যই বাদ দিতে হবে৷”

আর হেফাজতে ইসলাম বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর ধর্মাচার৷ ভারতীয় ষড়যন্ত্রে আনন্দ শোভাযাত্রাকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপান্তর করা হয়েছে৷” তারা এই নাম পরিবর্তন করে ইউনেস্কোকে ভুল সংশোধনে চিঠি দিতে অন্তর্বতী সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘এদের (বর্তমান সরকার) তো এখন একদিকে ইসলামিক দলগুলোকে ঠান্ডা রাখতে হচ্ছে৷ আবার পশ্চিমা বিশ্বকে ঠান্ডা রাখতে হচ্ছে৷  তাই তারা কখন কী করছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা৷  এই মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম এর আগে বিএনপির আমলেও পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে৷ আসলে এগুলো টিকবেনা৷ কিছুদিন হয়তো জোর করে চাপিয়ে দেয়া যাবে৷ এখানে তো এক সময় রবীন্দ্র সঙ্গীতও নিষিদ্ধের চেষ্টা করা হয়েছে৷”

তার কথা, ‘‘সরকারের দায়িত্ব হলো ঐতিহ্যকে রক্ষা করা৷ সেটা করা হচ্ছেনা৷ ইউনোস্কো যে ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে সেটাকে তারা পরিবর্তন করছে৷ জোর করে কোনো পরিবর্তন টিকিয়ে রাখা যায়না৷”

এবার এই মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের দায়িত্ব ছিলো ঐহিত্যগতভাবে চারুকলার ২৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের৷ তাদের আয়োজন করতে দেয়া হয়নি৷ তারাও তাই আয়োজনে কোনো ধরনের অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে৷ ওই ব্যাচের প্রতিনিধি জাদিদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করলেন৷ এখন কি মঙ্গলবারের নামও পরিবর্তন করবেন? কী নাম রাখবেন, সোমবারের পর হবে আনন্দবার? শনিবারের নামও তো পরিবর্তন করতে হবে৷ শনি তো হিন্দুদের এক দেবতার নাম৷ আর আপনি কত পরিবর্তন করবেন৷”

তিনি বলেন, ‘‘আসলে কোনো মহলের চাপে, কোনো মহলকে খুশি করতে এই পরিবর্তন করা হয়েছে৷ এখানে ইসলামের নামে কোনো কোনো গোষ্ঠী এই পরিবর্তন চায়৷ তারা মঙ্গল শোভাযাত্রাকেই মানতে পারছেনা৷ তাদের চাপে এটা করা হচ্ছে৷ কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে,” প্রশ্ন তার৷

সার্বজনীনতার দায়

মঙ্গল শোভাযাত্রার ঐতিহ্য, ব্যাপকতা ও সার্বজনীনতার কারণে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে৷

এখন এই পরিবর্তনের কারণে এই স্বীকৃতি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ৷

চারুকলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘এখন যে নতুন সরকার তাদের থিম হলো আগের যা আছে তা সবই বাতিল করে দিতে হবে৷ সেই কারণে তারা নাম পরিবর্তন করেছে বলে আমার ধারণা৷ এর খারাপ দিকটি হলো এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে যে ইউনোস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে সেখান থেকে আমরা পিছিয়ে এলাম৷”

তবে অনুষদের বর্তমান ডিন দাবি করেন, ‘‘নাম পরিবর্তনের ফলে ইউনোস্কোর ঐতিহ্য নিয়ে কোনো সমস্যা হবেনা৷ কারণ তারা কোনো সাইট বা ইভেন্টকে স্বীকৃতি দেয়৷”

এবারের আয়োজনে ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মধ্য শোভাযাত্রাটি সকলের হয়ে উঠবে বলেও মনে করছেন আয়োজন সংশ্লিষ্টরা৷

এর আগে গত ২৩ মার্চ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী৷

বর্ষবরণের প্রস্তুতিকে ঘিরে একাধিক অনুষ্ঠান মোস্তফা সরয়ার ফারুকী৷ শোভাযাত্রা বললেও এড়িয়ে গেছেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি৷

চারুকলা অনুষদ থেকেও প্রস্তুতির খবর জানাতে সাংবাদিকদের যে আমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়, সেখানেও ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ না লিখে, কেবল ‘শোভাযাত্রা’র কথা উল্লেখ করা হয়৷ ডয়চে ভেলে

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

স্কয়ার ফার্মারর বিরুদ্ধে ডোজ প্রতারণা ও রিপ্যাকিংয়ের অভিযোগে প্রেস কনফারেন্স শনিবার

‘আওয়ামী ও মঙ্গলমুক্ত’ বর্ষণবরণ শোভাযাত্রা!

Update Time : ০৮:৫৬:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫

বাংলা নববর্ষ বরণের সবচেয়ে বড় আয়োজন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ নাম বদলে হলো ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’৷ আয়োজকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে একে আওয়ামী মুক্ত করা হয়েছে৷ তবে অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ধান্তের পেছনে ধর্মীয় বিবেচনা রয়েছে৷

মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুক্রবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন নাম পরিবর্তনের৷ এ সময় তারা এর কারণ হিসেবে একে আওয়ামীমুক্তকরণের কথা বলেছেন৷

নাম বদলের কারণ যা বলা হলো

শুক্রবার চারুকলা অনুষদে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম এবারের শোভাযাত্রার নাম ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ ঘোষণা করেন৷ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আগেও পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রাটি হত, তার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’৷ সেটি পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল৷ আমরা আবার ‘আনন্দ শোভাযাত্রায়’ ফিরে গেলাম৷ এটাকে পুনরুদ্ধার বলা যেতে পারে৷”

শুক্রবার সন্ধ্যায় অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯৯০ সালে যখন আনন্দ শোভাযাত্রা নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয় তখন এর ভিতরে রাজনীতি ছিলো৷ এখন নাম পুনরুদ্ধার করে আওয়ামীমুক্ত করা হলো৷”

এর আগে একই সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেছেন, ‘‘আমরা নাম পরিবর্তন করছি না৷ আমরা পুরোনো নাম এবং ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি, যেটা দিয়ে চারুকলার এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল৷”

অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘‘আনন্দ শোভাযাত্রা নাম ছিলো৷ পরের বছর এই নাম যখন ওয়াহিদুল হকের প্রস্তাবে  মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয় তখন এরমধ্যে একটা রাজনীতি ছিলো৷ এটাকে রাজনৈতিক করা হয়েছে৷ সার্বজনীন আর ছিলোনা৷ ওই সময় তো আমিও ছিলাম৷ আওয়ামী লীগের লোকজন এটাকে দখল করে নিয়েছিলো৷ তারা তাদের লোকজনকে এরমধ্যে ঢুকিয়েছে৷”

‘‘আসলে আনন্দ আর মঙ্গল শব্দ নিয়ে কোনো সমস্যা নয়৷ ওই দুইটি শব্দের অর্থ নিয়েও কোনো সমস্যা নেই৷ সমস্যা রাজনীতি নিয়ে৷ আওয়ামী লীগের লোকজন রাজনীতি ঢুকিয়ে এটা সবার না করে তাদের দলীয় অনুষ্ঠানে পরিণত করেছিল৷ সেটা দূর করা হলো,” বলেন তিনি৷

নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে  পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা আওয়ামী দলখমুক্ত হলো কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ , অনেকটাই দখলমুক্ত হলো৷”

কীভাবে এলো মঙ্গল শোভাযাত্রা

যারা ঐহিত্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু করেছিলেন তারা বলছেন, আসলে পর্যায়ক্রমে এই আয়োজনের নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়৷ এটা মোটেই চাপিয়ে দেয়া হয়নি৷

বাংলা নর্ববর্ষে প্রথম শোভাযাত্রা হয় ১৯৮৫ সালে যশোরে৷ এর আয়োজক ছিলো যশোরের চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট৷ তার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মাহবুব জামিল শামীম৷ তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে যশোরে এর নাম ছিলো বর্ষবরণ শোভাযাত্রা৷ পরের বছর এটা ময়মসিংহে হয়৷  পরে ঢাকার চারুকলায় ১৯৮৯ সালে এটা আনন্দ শোভাযাত্রা নামে শুরু করি৷ ১৯৯০ সালে এর নাম দেয়া হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা৷”

মাহবুব জামিল শামীম আরো বলেন, নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’৷

‘‘তখনও আমি চারুকলার মাস্টার্সের ছাত্র৷ সিনিয়ররা বললেন, বাংলা বছরের প্রথম দিনে আমরা সবার মঙ্গল কামনা করতে চাই ,” জানান তিনি৷

তার কথা, ‘‘২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির মত আমরা একটি সার্বজনীন আয়োজন চেয়েছিলাম৷ আর সেটাই ১৯৯০ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম নিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ এই নামটি সবাই গ্রহণ করছেন৷ এখন কেন নাম পরিবর্তন করা হলো তা যারা করেছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন৷ আমার কোনো মন্তব্য নাই৷ তবে তখনো নববর্ষের এই বাঙালি সংস্কৃতির আয়োজনকে মেনে নিতে পারতনা কেউ কেউ৷ নানা কথা বলত৷ মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সমালোচনা করত৷ তবে তখন তারা সংখ্যায় কম ছিলো৷”

যশোরের ওই বাংলা বর্ষবরণ শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের আরেকজন চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বর্তমান সভাপতি হারুন-অর-রশীদ  বলেন, ‘‘শুরুতে আমরা একাধিক নামে করেছি৷ ঢাকায় নিয়ে আসার পর মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটি সর্বসম্মতভাবেই  গ্রহণ করা হয়৷ আমাদেরও মনে হয়েছে ওই নামটি সার্বজনীন৷ কারণ বছরের শুরুতে মঙ্গল কামনার জন্যই আমাদের আয়োজন৷”

মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই পরিবর্তনের পেছনে ধর্মীয় রাজনীতি দেখছেন কেউ কেউ৷

চারুকলার সাবেক ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘আসলে যারা এই পরিবর্তন করেছেন তারা বাঙালি সংস্কৃতি কখনো মানতে পারেননি৷  তারা বাঙালি সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি মনে করেন৷ সুযোগ বুঝে তাই নাম পরিবর্তন করে ফেলেছেন৷”

আর অতীতের মত এবারও ইসলামি দল ও সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান প্রকাশ করে  আসছিলো৷

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে ও ধারণায়’ কিছু করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম৷

তিনি বলেছেন, ‘‘নববর্ষের দিন মানুষ শালীনতা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সমর্থিত পন্থায় নানা আয়োজন করতেই পারে৷ কিন্তু সেই দিন কোনো যাত্রা করলে তাতে মঙ্গল হবে- এমন বিশ্বাস করলে বা ধারণা করলে পরিষ্কারভাবে তা গুনাহের দিকে নিয়ে যাবে৷ তাই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে কোনো কিছু অবশ্যই করা যাবে না৷ ‘মঙ্গল শব্দ ও ধারণা’ অবশ্যই বাদ দিতে হবে৷”

আর হেফাজতে ইসলাম বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর ধর্মাচার৷ ভারতীয় ষড়যন্ত্রে আনন্দ শোভাযাত্রাকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপান্তর করা হয়েছে৷” তারা এই নাম পরিবর্তন করে ইউনেস্কোকে ভুল সংশোধনে চিঠি দিতে অন্তর্বতী সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘এদের (বর্তমান সরকার) তো এখন একদিকে ইসলামিক দলগুলোকে ঠান্ডা রাখতে হচ্ছে৷ আবার পশ্চিমা বিশ্বকে ঠান্ডা রাখতে হচ্ছে৷  তাই তারা কখন কী করছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা৷  এই মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম এর আগে বিএনপির আমলেও পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে৷ আসলে এগুলো টিকবেনা৷ কিছুদিন হয়তো জোর করে চাপিয়ে দেয়া যাবে৷ এখানে তো এক সময় রবীন্দ্র সঙ্গীতও নিষিদ্ধের চেষ্টা করা হয়েছে৷”

তার কথা, ‘‘সরকারের দায়িত্ব হলো ঐতিহ্যকে রক্ষা করা৷ সেটা করা হচ্ছেনা৷ ইউনোস্কো যে ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে সেটাকে তারা পরিবর্তন করছে৷ জোর করে কোনো পরিবর্তন টিকিয়ে রাখা যায়না৷”

এবার এই মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের দায়িত্ব ছিলো ঐহিত্যগতভাবে চারুকলার ২৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের৷ তাদের আয়োজন করতে দেয়া হয়নি৷ তারাও তাই আয়োজনে কোনো ধরনের অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে৷ ওই ব্যাচের প্রতিনিধি জাদিদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করলেন৷ এখন কি মঙ্গলবারের নামও পরিবর্তন করবেন? কী নাম রাখবেন, সোমবারের পর হবে আনন্দবার? শনিবারের নামও তো পরিবর্তন করতে হবে৷ শনি তো হিন্দুদের এক দেবতার নাম৷ আর আপনি কত পরিবর্তন করবেন৷”

তিনি বলেন, ‘‘আসলে কোনো মহলের চাপে, কোনো মহলকে খুশি করতে এই পরিবর্তন করা হয়েছে৷ এখানে ইসলামের নামে কোনো কোনো গোষ্ঠী এই পরিবর্তন চায়৷ তারা মঙ্গল শোভাযাত্রাকেই মানতে পারছেনা৷ তাদের চাপে এটা করা হচ্ছে৷ কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে,” প্রশ্ন তার৷

সার্বজনীনতার দায়

মঙ্গল শোভাযাত্রার ঐতিহ্য, ব্যাপকতা ও সার্বজনীনতার কারণে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে৷

এখন এই পরিবর্তনের কারণে এই স্বীকৃতি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ৷

চারুকলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘এখন যে নতুন সরকার তাদের থিম হলো আগের যা আছে তা সবই বাতিল করে দিতে হবে৷ সেই কারণে তারা নাম পরিবর্তন করেছে বলে আমার ধারণা৷ এর খারাপ দিকটি হলো এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে যে ইউনোস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে সেখান থেকে আমরা পিছিয়ে এলাম৷”

তবে অনুষদের বর্তমান ডিন দাবি করেন, ‘‘নাম পরিবর্তনের ফলে ইউনোস্কোর ঐতিহ্য নিয়ে কোনো সমস্যা হবেনা৷ কারণ তারা কোনো সাইট বা ইভেন্টকে স্বীকৃতি দেয়৷”

এবারের আয়োজনে ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মধ্য শোভাযাত্রাটি সকলের হয়ে উঠবে বলেও মনে করছেন আয়োজন সংশ্লিষ্টরা৷

এর আগে গত ২৩ মার্চ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী৷

বর্ষবরণের প্রস্তুতিকে ঘিরে একাধিক অনুষ্ঠান মোস্তফা সরয়ার ফারুকী৷ শোভাযাত্রা বললেও এড়িয়ে গেছেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি৷

চারুকলা অনুষদ থেকেও প্রস্তুতির খবর জানাতে সাংবাদিকদের যে আমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়, সেখানেও ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ না লিখে, কেবল ‘শোভাযাত্রা’র কথা উল্লেখ করা হয়৷ ডয়চে ভেলে