ঢাকা ০৭:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo শ্রীমঙ্গলে সাংবাদিকদের সাথে সংসদ সদস্য প্রার্থী হারুনুর রশিদের মতবিনিময় সভা Logo মোবাইল-ই কাল হলো নবম শ্রেণীর ছাত্রী জ্যামির, শিক্ষকের শাসন -অতঃপর বিষপানের মৃত্যু Logo রাজধানীর বাড্ডা ও শাহজাদপুরে ২ বাসে আগুন Logo রাজধানীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে একজন নিহত Logo চুয়াডাঙ্গায় অবৈধ সার ব্যবসায়ীকে ১ মাসের কারাদণ্ড ও জরিমানা Logo মহাদেবপুরে আদালতের আদেশ অমান্য করে স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা Logo দুর্গাপুরে ‎রাজশাহী-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন  Logo শীতের গন্ধ, তাপমাত্রা কমছে প্রতিদিন দুই ডিগ্রি ঈশ্বরদীতে দোকানে উঠছে শীতের সোয়েটার-জ্যাকেট, কম্বল Logo পদ্মার চরজুড়ে চলছে ‘অপারেশন ফার্স্ট লাইট’ Logo নীলফামারীতে চার দফা দাবী বাস্তবায়নে বিসিএস প্রভাষক পরিষদের মানবন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন

চাঞ্চল্যকর পিন্টু হত্যা মামলার বাদীকে প্রাণনাশের হুমকি ও এলাকায় বোমাবাজি

নিহত পুলিশের সোর্স পিন্টু

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নে চলছে চরম অস্থিরতা ও আতঙ্ক। আলোচিত পিন্টু হত্যা মামলার মূল আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া এবং বাদীপক্ষের উপর ক্রমাগত হুমকি, অপপ্রচার ও সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগে ক্ষোভে ফুঁসছে স্থানীয় জনতা।

নিহত পিন্টুর পরিবার ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, মামলা থেকে বাঁচতে প্রভাবশালী আসামিপক্ষ নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা কখনো ভয়ভীতি প্রদর্শন, আবার কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে মামলার গতিপথ ঘুরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আব্দুল হাকিম পিন্টু নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সকে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। গত ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চরবাগডাঙ্গার বাসিন্দা আব্দুল হাকিম পিন্টু। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক গোপন সোর্স হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং স্থানীয়ভাবে মাদকবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। তার মৃত্যুর পরদিন, ২৪ জানুয়ারি, নিহত পিন্টুর পিতা মো. হুমায়ুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় স্থানীয় চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উত্তরবঙ্গের মাদকসম্রাট খ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা শহিদ রানা টিপুকে। মামলায় আরও ১৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়, যাদের অধিকাংশই মাদক ব্যবসা ও মাদক সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিহতের পরিবারের দাবি, পিন্টু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে শহীদ রানা টিপুর মাদক কারবার সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করত। এর জের ধরেই পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে সাহারুল আলম কালু, মিজানুর রহমান মিজান, আজিজুল ইসলাম এবং আশরাফ আলীর মতো প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারাও রয়েছেন, যাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে পূর্ব থেকেই নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

এই ঘটনায় তদন্ত ও বিচারে ধীরগতির অভিযোগ তুলে এখন হতাশা আর ক্ষোভে কাতর হয়ে পড়েছেন নিহত পিন্টুর পরিবার। তারা বলছেন, একদিকে খুনীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অপরদিকে মামলা পরিচালনায় বাদীপক্ষকে প্রতিনিয়ত ভয়ভীতি, হুমকি—ধামকি, এমনকি প্রাণনাশের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে।

সেই সূত্রে ধরে গত ২ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার বিকেলে, মোঃ শাহিদ রানা টিপুর নির্দেশে তার অনুসারীরা নিহত পিন্টুর পিতা হুমায়ুন ও তার ভাইয়ের দোকান খুলতে বাধা দেন এবং তাদের ওপর চড়াও হয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, টিপুর অনুসারীরা দলবদ্ধ হয়ে এসে দোকানে ভাঙচুর চালায় এবং পরিবারের সদস্যদের মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। সেই রাতে চরবাগডাঙ্গা এলাকায় একাধিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যার ফলে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে ও জনমনে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়দের দাবি, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত হামলা, যার মাধ্যমে এলাকাবাসীর মনে ভীতি তৈরি করে খুনীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া বা মামলা পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

এছাড়াও, ৩ এপ্রিল রাতেও এলাকায় আবারো একাধিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। ধারাবাহিক এই বিস্ফোরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। তারা দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

উল্লেখিত ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত আব্দুল হাকিম পিন্টুর পিতা মো. হুমায়ুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় একটি এজাহার দায়ের করেছেন। গত ৩ এপ্রিল করা ওই মামলায় শাহিদ রানা টিপুকে প্রধান আসামি করে মোট ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, হামলা, ভাঙচুর, প্রাণনাশের হুমকি এবং বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে মামলার স্বাক্ষীদের হত্যার ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল।

তবে নিহত পিন্টুর পরিবারের নতুন দায়ের করা মামলাকে প্রতিহত করতে এবং গোটা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টায়, শাহিদ রানা টিপু ও তার অনুসারীরা একপ্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই মিথ্যা বানোয়াট কল্পকাহিনী রচনা করে পাল্টা এজাহার দায়ের করেন। গত ৪ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় করা ওই মামলায় ৪৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এ ঘটনায় জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নিহতের পিতা হুমায়ুন প্রকৃতপক্ষে একজন নিযার্তিত ব্যক্তি, যিনি পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে থানায় মামলা করেছেন। অথচ উল্টো খুন ও নিযার্তনের অভিযোগে অভিযুক্তরাই সাধারণ নিরীহ মানুষদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাদের হয়রানি করছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই—পিন্টু হত্যার মতো একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার দায় থেকে যেকোনো মূল্যে রেহাই পাওয়া।

স্থানীয়দের মতে, এই পাল্টা মামলা মূলত খুনীদের অপরাধ ঢাকতে এবং স্বাক্ষীদের মুখ বন্ধ রাখতে একটি সাজানো নাটক।
অন্যদিকে, নিহত পিন্টুর স্ত্রী পারভীন বেগমের আচরণ নিয়ে উঠেছে নানা মহলে বিভিন্ন প্রশ্ন। মামলার শুরুতে তিনি খুনীদের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন এবং সাংবাদিকদের সামনে বারবার বিচার দাবি করছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি হঠাৎ করেই আসামিপক্ষের অবস্থান নিতে শুরু করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

নিহতের পরিবার দাবি করে বলেন, পারভীন বেগমকে খুনীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কিনে নেওয়া হয়েছে এবং তাকে দিয়ে মামলা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে।

নিহতের বোন জান্নাতুন খাতুন লাবনী বলেন, আমরা ভীষণ হতাশ, প্রায় তিন মাস হয়ে গেলেও এখনও আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা আমাদের বারবার হুমকি দিচ্ছে। খুনীরা আমাদের পরিবারের কথাবার্তা এডিট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।

তিনি আরও জানান, পারভীন বেগম কিছুদিন আগেও ক্যামেরার সামনে আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি তুলেছিলেন, অথচ এখন তিনি বলছেন, খুনীরা নিরপরাধ।

নিহতের পিতা হুমায়ুন বলেন,আমার ছেলে ছিলো মাদকবিরোধী সোর্স। সে শহীদ রানা টিপুর মাদক কারবারের তথ্য দিয়ে ফেলায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। এখন খুনীদের বাঁচাতে আমার ছেলের স্থীকে(বউ) ব্যবহার করছে তারা। আমার করা মামলার বাইরে সে আরেকটি মামলা দিয়েছে, যেখানে নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। সে এখন খুনীদের পুতুল হয়ে গেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে নিহত পিন্টুর স্ত্রী পারভীন বেগমের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, যেখানে সারা দেশে মাদক কারবারি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকার অভিযান চালাচ্ছে, সেখানে এই অঞ্চলের সবচেয়ে কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী শহীদ রানা টিপু কীভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়? এই প্রশ্ন এখন পুরো এলাকার মানুষের মনে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, শহীদ রানা টিপু এবং তার অনুসারীরা প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলছে,একটা খেয়েছি, আরও খাবো। প্রশাসন বা কেউ কিছু করতে পারবে না। পিন্টুর মতো আরও অনেককে শায়েস্তা করবো। এমন প্রকাশ্য হুমকি ও সন্ত্রাসের পরও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে মামলার প্রধান আসামি শাহিদ রানা টিপুসহ অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রত্যেকের ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, গ্রেপ্তার এড়াতেই আসামিরা সবাই আত্মাগোপনে রয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মতিউর রহমান বলেন, পিন্টুর বাবা হুমায়নের দায়ের করা মামলায় ২০ জন এজাহারনামীয় আসামির মধ্যে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ এবং বাকি আসামিদের আটক করতে কাজ করছে তারা। তবে নিহতের পরিবার বলছে, এই কথাবার্তা কেবল আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে কোনও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

এলাকাবাসী, নিহতের পরিবার, এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা একবাক্যে দাবি তুলেছেন—এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা শাহিদ রানা টিপু ও তার সহযোগীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে চরবাগডাঙ্গা আবারও রক্তাক্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

শ্রীমঙ্গলে সাংবাদিকদের সাথে সংসদ সদস্য প্রার্থী হারুনুর রশিদের মতবিনিময় সভা

চাঞ্চল্যকর পিন্টু হত্যা মামলার বাদীকে প্রাণনাশের হুমকি ও এলাকায় বোমাবাজি

Update Time : ১১:৫০:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল ২০২৫

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নে চলছে চরম অস্থিরতা ও আতঙ্ক। আলোচিত পিন্টু হত্যা মামলার মূল আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া এবং বাদীপক্ষের উপর ক্রমাগত হুমকি, অপপ্রচার ও সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগে ক্ষোভে ফুঁসছে স্থানীয় জনতা।

নিহত পিন্টুর পরিবার ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, মামলা থেকে বাঁচতে প্রভাবশালী আসামিপক্ষ নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা কখনো ভয়ভীতি প্রদর্শন, আবার কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে মামলার গতিপথ ঘুরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আব্দুল হাকিম পিন্টু নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সকে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। গত ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চরবাগডাঙ্গার বাসিন্দা আব্দুল হাকিম পিন্টু। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক গোপন সোর্স হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং স্থানীয়ভাবে মাদকবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। তার মৃত্যুর পরদিন, ২৪ জানুয়ারি, নিহত পিন্টুর পিতা মো. হুমায়ুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় স্থানীয় চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উত্তরবঙ্গের মাদকসম্রাট খ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা শহিদ রানা টিপুকে। মামলায় আরও ১৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়, যাদের অধিকাংশই মাদক ব্যবসা ও মাদক সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিহতের পরিবারের দাবি, পিন্টু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে শহীদ রানা টিপুর মাদক কারবার সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করত। এর জের ধরেই পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে সাহারুল আলম কালু, মিজানুর রহমান মিজান, আজিজুল ইসলাম এবং আশরাফ আলীর মতো প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারাও রয়েছেন, যাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে পূর্ব থেকেই নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

এই ঘটনায় তদন্ত ও বিচারে ধীরগতির অভিযোগ তুলে এখন হতাশা আর ক্ষোভে কাতর হয়ে পড়েছেন নিহত পিন্টুর পরিবার। তারা বলছেন, একদিকে খুনীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অপরদিকে মামলা পরিচালনায় বাদীপক্ষকে প্রতিনিয়ত ভয়ভীতি, হুমকি—ধামকি, এমনকি প্রাণনাশের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে।

সেই সূত্রে ধরে গত ২ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার বিকেলে, মোঃ শাহিদ রানা টিপুর নির্দেশে তার অনুসারীরা নিহত পিন্টুর পিতা হুমায়ুন ও তার ভাইয়ের দোকান খুলতে বাধা দেন এবং তাদের ওপর চড়াও হয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, টিপুর অনুসারীরা দলবদ্ধ হয়ে এসে দোকানে ভাঙচুর চালায় এবং পরিবারের সদস্যদের মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। সেই রাতে চরবাগডাঙ্গা এলাকায় একাধিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যার ফলে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে ও জনমনে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়দের দাবি, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত হামলা, যার মাধ্যমে এলাকাবাসীর মনে ভীতি তৈরি করে খুনীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া বা মামলা পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

এছাড়াও, ৩ এপ্রিল রাতেও এলাকায় আবারো একাধিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। ধারাবাহিক এই বিস্ফোরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। তারা দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

উল্লেখিত ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত আব্দুল হাকিম পিন্টুর পিতা মো. হুমায়ুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় একটি এজাহার দায়ের করেছেন। গত ৩ এপ্রিল করা ওই মামলায় শাহিদ রানা টিপুকে প্রধান আসামি করে মোট ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, হামলা, ভাঙচুর, প্রাণনাশের হুমকি এবং বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে মামলার স্বাক্ষীদের হত্যার ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল।

তবে নিহত পিন্টুর পরিবারের নতুন দায়ের করা মামলাকে প্রতিহত করতে এবং গোটা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টায়, শাহিদ রানা টিপু ও তার অনুসারীরা একপ্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই মিথ্যা বানোয়াট কল্পকাহিনী রচনা করে পাল্টা এজাহার দায়ের করেন। গত ৪ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় করা ওই মামলায় ৪৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এ ঘটনায় জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নিহতের পিতা হুমায়ুন প্রকৃতপক্ষে একজন নিযার্তিত ব্যক্তি, যিনি পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে থানায় মামলা করেছেন। অথচ উল্টো খুন ও নিযার্তনের অভিযোগে অভিযুক্তরাই সাধারণ নিরীহ মানুষদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাদের হয়রানি করছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই—পিন্টু হত্যার মতো একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার দায় থেকে যেকোনো মূল্যে রেহাই পাওয়া।

স্থানীয়দের মতে, এই পাল্টা মামলা মূলত খুনীদের অপরাধ ঢাকতে এবং স্বাক্ষীদের মুখ বন্ধ রাখতে একটি সাজানো নাটক।
অন্যদিকে, নিহত পিন্টুর স্ত্রী পারভীন বেগমের আচরণ নিয়ে উঠেছে নানা মহলে বিভিন্ন প্রশ্ন। মামলার শুরুতে তিনি খুনীদের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন এবং সাংবাদিকদের সামনে বারবার বিচার দাবি করছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি হঠাৎ করেই আসামিপক্ষের অবস্থান নিতে শুরু করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

নিহতের পরিবার দাবি করে বলেন, পারভীন বেগমকে খুনীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কিনে নেওয়া হয়েছে এবং তাকে দিয়ে মামলা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে।

নিহতের বোন জান্নাতুন খাতুন লাবনী বলেন, আমরা ভীষণ হতাশ, প্রায় তিন মাস হয়ে গেলেও এখনও আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা আমাদের বারবার হুমকি দিচ্ছে। খুনীরা আমাদের পরিবারের কথাবার্তা এডিট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।

তিনি আরও জানান, পারভীন বেগম কিছুদিন আগেও ক্যামেরার সামনে আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি তুলেছিলেন, অথচ এখন তিনি বলছেন, খুনীরা নিরপরাধ।

নিহতের পিতা হুমায়ুন বলেন,আমার ছেলে ছিলো মাদকবিরোধী সোর্স। সে শহীদ রানা টিপুর মাদক কারবারের তথ্য দিয়ে ফেলায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। এখন খুনীদের বাঁচাতে আমার ছেলের স্থীকে(বউ) ব্যবহার করছে তারা। আমার করা মামলার বাইরে সে আরেকটি মামলা দিয়েছে, যেখানে নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। সে এখন খুনীদের পুতুল হয়ে গেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে নিহত পিন্টুর স্ত্রী পারভীন বেগমের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, যেখানে সারা দেশে মাদক কারবারি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকার অভিযান চালাচ্ছে, সেখানে এই অঞ্চলের সবচেয়ে কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী শহীদ রানা টিপু কীভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়? এই প্রশ্ন এখন পুরো এলাকার মানুষের মনে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, শহীদ রানা টিপু এবং তার অনুসারীরা প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলছে,একটা খেয়েছি, আরও খাবো। প্রশাসন বা কেউ কিছু করতে পারবে না। পিন্টুর মতো আরও অনেককে শায়েস্তা করবো। এমন প্রকাশ্য হুমকি ও সন্ত্রাসের পরও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে মামলার প্রধান আসামি শাহিদ রানা টিপুসহ অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রত্যেকের ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, গ্রেপ্তার এড়াতেই আসামিরা সবাই আত্মাগোপনে রয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মতিউর রহমান বলেন, পিন্টুর বাবা হুমায়নের দায়ের করা মামলায় ২০ জন এজাহারনামীয় আসামির মধ্যে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ এবং বাকি আসামিদের আটক করতে কাজ করছে তারা। তবে নিহতের পরিবার বলছে, এই কথাবার্তা কেবল আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে কোনও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

এলাকাবাসী, নিহতের পরিবার, এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা একবাক্যে দাবি তুলেছেন—এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা শাহিদ রানা টিপু ও তার সহযোগীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে চরবাগডাঙ্গা আবারও রক্তাক্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।