ঢাকা: প্রায় সোয়া তিনশ' মামলার আসামী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এরমধ্যে একটি মামলার চার্জশিট এ মাসেই ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম৷

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় সারাদেশে প্রায় দেড় হাজার মামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে হত্যার অভিযোগে প্রায় ৬০০ মামলা হয়েছে৷ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট মামলার সংখ্যা ৩২৪টি যার মধ্যে ঢাকাতেই মামলা হয়েছে ২৯৭টি৷ বাকি ২৭টি মামলা হয়েছে ঢাকার বাইরে৷ তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলার চার্জশিট চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে৷ মামলাটি হলো গত জুলাই-আগস্টে সারাদেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরকারের উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় সংক্রান্ত৷ এ মাসেই ট্রাইব্যুনালে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে  জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম৷

তিনি বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত তিনটি মামলার তদন্ত চূড়ান্ত হয়েছে৷ এর মধ্যে প্রথমে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে আশুলিয়ায় থানার মধ্যে গাড়িতে ছয় জনকে পুড়িয়ে হত্যার তদন্ত রিপোর্ট৷ এরপর রাজধানীর চানখারপুলে হত্যার তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হবে৷ এরপর যে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হবে সেটি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে৷ এটি একটি পৃথক রিপোর্ট হবে৷ যেখানে শেখ হাসিনাকে সুপেরিয়র রেসপন্সসিবিলিটির (উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায়) অভিযোগে

সারাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে সেই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হবে৷সবগুলো মামলাতে শেখ হাসিনাকে আনা হবে না, একটি মামলার মধ্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো উপস্থাপন করা হবে৷ সেখানে আমরা অভিযোগ প্রমানের পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমান পেয়েছি৷ আমাদের কাছে যে অকাট্য প্রমান এসেছে তাতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ একাধিকবার প্রমাণ করা যাবে৷''

উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায়ের কারণে ওই মামলায় কি শুধু শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামী থাকবেন? জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘‘এখনও এটা ঠিক করা হয়নি৷ শুধু শেখ হাসিনাও থাকতে পারেন৷ আবার তার কমান্ডের প্রেক্ষিতে যারা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেছেন তাদের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও আসামী হতে পারেন৷''

কবে নাগাদ এই চার্জশিট দাখিল হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘প্রাথমিক রিপোর্ট আমাদের হাতে চলে এসেছে৷ এটি এখন যাচাই বাছাই করা হচ্ছে৷ এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ লাগতে পারে৷ অর্থাৎ এ মাসেই এই তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করছি৷''

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যত মামলা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় সোয়া তিনশ মামলা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে৷ পুলিশ সদর দপ্তরের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যে আমরা তার বিরুদ্ধে ৩২৪টি মামলা পেয়েছি৷ এর মধ্যে ঢাকাতেই মামলা হয়েছে ২৯৭টি আর ঢাকার বাইরে ২৭টি৷ আর সারাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানে মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৪৯৯টি৷ এর মধ্যে ৫৯৯টি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ এখন এই মামলাগুলোর তদন্ত চলছে৷ তবে কবে নাগাদ তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব হবে সেটি বলা যাচ্ছে না৷''

আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে বলছে, ৫ আগস্টের পর এখন পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানা ও আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, গুম ও অপহরণের অভিযোগে ২৭৬টি মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা৷ অন্যদিকে ঢাকা জেলার বিভিন্ন থানা ও আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আরও অন্তত ২৭টি৷ সেই হিসাবে ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৩০৩৷ এর মধ্যে দুই শতাধিক মামলা হচ্ছে হত্যার৷ তবে ঢাকার বাইরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে থানা ও আদালতে কতটি মামলা হয়েছে, তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাওয়া যায়নি৷ তবে ঢাকার বাইরে কমপক্ষে ২৫টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে৷

মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী  বলেন, ‘‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে৷ এখন পর্যন্ত কোন মামলার চার্জশিট দাখিল করার পর্যায়ে আসেনি৷ মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্তের নানা বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করছেন৷ তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে রিপোর্ট দাখিলের চেষ্টা করছেন৷ যাতে কোন ফাঁক-ফোকর না থাকে৷ যত দ্রুত সম্ভব তারা রিপোর্ট দেবেন৷''

মামলা ও ট্রাইব্যুনালের তদন্তের ধরন

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন ৮৪৪ জন৷ আহত হয়েছেন আরও ১৩ হাজার ২৫৮ জন৷ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ ২৭ জন মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ গ্রেপ্তার হয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের ছয়জন প্রতিমন্ত্রী ও তিনজন উপমন্ত্রী৷ গ্রেপ্তার হয়েছেন তার তিন উপদেষ্টাও৷ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ৪৩ সংসদ সদস্য ও সাবেক ১১ জন আমলা৷ পুলিশের সাবেক দুজন মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) ২৮ জন পুলিশ কর্মকর্তাও গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি ও পাঁচজন সাংবাদিকসহ গ্রেপ্তার আছেন ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ৷

ট্রাইব্যুনালের তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা  বলেন, ‘‘ট্রাইব্যুনালে তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের পর সেটা দেখে নিশ্চিত হওয়া যাবে কীভাবে তারা তদন্ত করেছেন৷ তবে আমি মনে করি, মামলাগুলোর এজাহারের মতো যেনতেন ভাবে যদি তদন্ত করা হয় তাহলে এখানে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হতে পারে৷ এখানে বাদি-আসামি সাবাই যেন মনে করেন তারা ন্যায় বিচার পাবেন সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে৷ আর যদি মনে করা হয়, আসামী পক্ষের দরকার নেই তাহলে কিন্তু ন্যায়বিচার হবে না৷

সম্প্রতি হাইকোর্টে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সব আসামীকে খালাস দেওয়া হয়েছে৷সেখানে কিন্তু আদালত বলেছেন, একটা মবের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে ঘটনা ঘটানো হয়েছে৷ ফলে ঘটনাটা ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু আসামী নির্ধারণ করা যায়নি৷ এই বিষয়গুলোও আমাদের মাথায় রাখতে হবে৷''

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রের তথ্য বলছে, অভ্যুত্থানের ঘটনায় হত্যা মামলার মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) থানাগুলোয় সর্বাধিক ৩৩৩টি মামলা হয়েছে৷ এছাড়া ঢাকা রেঞ্জে ১৪৮টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ২০টি, রাজশাহী রেঞ্জে ২২টি, সিলেট রেঞ্জে ১৫টি, গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় ১৬টি, চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন এলাকায় ১০টি, সিলেট মেট্টোপলিটন এলাকায় ৩টি, খুলনা রেঞ্জে ১০টি, রংপুর রেঞ্জে ৮টি, রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫টি এবং ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৭টি মামলা হয়েছে৷ পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, মামলাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত তদারকি করতে সারাদেশে প্রত্যেকটি রেঞ্জ ও মেট্রোপলিটন সমন্বিত এলাকার জন্য একজন করে অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে সভাপতি করে ১০টি মেন্টর (পরামর্শক) কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ মামলার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী অবসরপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার ও বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছ থেকেও পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে৷