ঢাকার একজন ব্যবসায়ী জায়েদুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। রোববার তার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো বিবিসি বাংলার।
আলাপের শুরুতে "কেমন আছেন?" জানতে চাইলে জায়েদুল ইসলাম বলেন, "ভালো নেই।"
"কেন?"
"আগে চাঁদা দিতে হতো একজনরে, এখন দিতে হইতেছে চার-পাঁচজনরে। তাহলে কীভাবে ভালো থাকি বলেন?," জবাবে পাল্টা প্রশ্ন রাখেন জায়েদুল ইসলাম।
গত পাঁচই অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে একের পর এক চাঁদাবাজির কারণে রীতিমত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন বলে জানান ঢাকার এই ব্যবসায়ী।
"এখন তো আননোন (অপরিচিত) নাম্বার থেকে ফোন আসলেই ভয় লাগে। আবার কে জানি টাকা চায়!," বলছিলেন মি. ইসলাম।
রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থাকার পরও মামলার ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
"বিভিন্ন গ্রুপকে আমি এরই মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ টাকা দিয়েছি। তারপরও আরও টাকা চাচ্ছে। না দিলে মামলায় নাম ঢুকায় দিবে বলে হুমকি দিয়েই যাচ্ছে," বলেন মি. ইসলাম।
এই ব্যবসায়ী জানিয়েছেন যে, যারা চাঁদা নিয়েছেন এবং এখনও দাবি করছেন, তারা প্রায় সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
তবে ব্যবসা ও নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের কারো নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি।
মি. ইসলাম ছাড়াও ঢাকার অনেক ব্যবসায়ী এখন চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।
অধিকাংশক্ষেত্রেই বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী পরিচয়ে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দলটি ইতোমধ্যে প্রায় দেড় হাজারের মতো নেতাকর্মীকে বহিষ্কারও করেছে। কিন্তু তারপরও তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রীতিমত বেগ পেতে হচ্ছে দলটিকে।
এ অবস্থার জন্য সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকেই দুষছেন।
"আসলে বাংলাদেশের কালচারটাই নষ্ট করে দিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ," বিবিসি বাংলাকে বলেন বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
বিএনপি'র বাইরে গত কয়েক মাসে কোনো কোনো জেলায় জামায়াতে ইসলামী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠতে দেখা গেছে।
এর মধ্যে ফেনীতে জেলা জামায়াতের এক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, সরকার চাঁদাবাজি বন্ধে চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান।
"আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পুলিশকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে," বলেন মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান।
[caption id="attachment_717" align="aligncenter" width="300"]
ঢাকার কারওয়ান বাজারে ট্রাক থেকে পণ্য খালাস করার জন্যও চাঁদার টাকা দিতে হয়[/caption]
যশোর থেকে সবজিভর্তি ট্রাক নিয়ে ঢাকায় এসেছেন চালক সেলিম হোসেন। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসতে পথে তাকে চাঁদা দিতে হয়েছে অন্তত চারটি পয়েন্টে।
"যশোর থেকে নড়াইলে ঢুকার পর একবার চাঁন্দা দিতি হয়। এরপর গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, তারপর ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ঢুকে ৪০ টাকা, ৫০ টাকা করে চাঁন্দা দিয়া লাগে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সেলিম হোসেন।
এখানেই শেষ নয়। সবজি নিয়ে কারওয়ান বাজারে পৌঁছানোর গাড়ি রাখার জন্য এই চালককে গুনতে হয়েছে আরও দুইশ' টাকা।
"কতকিছু বদলাচ্ছে শুনতিছি। কই চাঁন্দাবাজি তো বন্ধ হয়নি! আমরা তো দেখতিছি, খালি কাপড় বদলাইছে," বলেন সেলিম হোসেন।
একই অভিযোগ করেন মোহাম্মদ সম্রাট নামের আরেকজন ট্রাক চালক। উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে কাঁচামাল নিয়ে তিনিই প্রায়ই কারওয়ান বাজারে আসেন।
"আগে নিতো আম্লীগ, এখন নেয় বিম্পি। টাকার মাফ নাই," বলছিলেন মোহাম্মদ সম্রাট।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মহাসড়কে চাঁদাবাজি আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে বলে জানান এই চালক।
"আগে হয়তো সাত-আট জায়গায় টাকা দেওয়া লাগতো। এখন লাগে তিন-চার জায়গায়। পুলিশরে দেওয়া লাগতেছে না," বলেন মোহাম্মদ সম্রাট।
[caption id="attachment_716" align="aligncenter" width="300"]
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলেছেন[/caption]
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সবজি, মশলা, মাছসহ নানান পণ্য নিয়ে প্রতিদিন কয়েকশ ট্রাক ও পিকআপ ভ্যান আসে ঢাকায় সবচেয়ে বড় কাঁচা বাজার কারওয়ান বাজারে।
বাজারে পণ্য আনার পর দুই ধাপে চাঁদার টাকা দিতে হয় বলে জানিয়েছেন গাড়ি চালক ও ব্যবসায়ীরা।
এর মধ্যে গাড়ি রাখার জন্য প্রথমধাপে আকারভেদে দিতে হয় একশ' থেকে তিনশ' টাকা। এরপর পণ্য খালাস করার জন্য ফের ট্রাকপ্রতি গুনতে হয় কমপক্ষে এক হাজার টাকা।
সাধারণত ঢাকার বাইরে থেকে যারা পণ্য নিয়ে বাজারে আসেন, টাকাটা তাদের পকেট থেকেই যায় বলে ভুক্তভোগিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে।
"এসব কারণে ঢাকায় আসার পর সবজির দাম বেড়ে যায়। না হলে পোষাবে কী-করে?" বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ব্যবসায়ী আমজাদ আলী (ছদ্মনাম)।
ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় মি. আলী নিজের প্রকৃত নাম প্রকাশ করতে চাননি। তিনি বলছিলেন যে, গণআন্দোলনের মুখে গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর কিছুদিন কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ ছিল।
"কারণ তখন ছাত্রগো ভয়ে কেউ সাহস পাইতো না। কিন্তু কিছুদিন যায়তে না যায়তেই আবার সব আগের মতো," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ওই ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিএনপি'র অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী পরিচয়েই এখন চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।
"কেউ আইয়া কয় যুবদল, কেউ ছাত্রদল। আরও আছে শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল। একেক সময় একেক গ্রুপ আহে," বলছিলেন বাজারের একজন আড়তদার।
"কয়জনরে টাকা দিমু? ওগো জ্বালাই আমরা অতিষ্ঠ," বিবিসি বাংলাকে বলেন ওই আড়তদার।
[caption id="attachment_715" align="aligncenter" width="300"]
কারওয়ান বাজার চিকেন মার্কেটের ছবি[/caption]
তবে বিএনপি'র সুপরিচিত কোনো নেতা এখন পর্যন্ত সশরীরে এসে চাঁদার টাকা দাবি করেননি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
"বড় কেউ তো আসেনা। চামচারা আইসা কয়: ভাই পাঠাইছে, টাকা দেন," বলছিলেন ব্যবসায়ী নাসির উদ্দীন (ছদ্মনাম)।
চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হলেও নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ব্যবসায়ীদের বেশিভাগই সুনির্দিষ্ট করে চাঁদাবাজদের কারো নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।
"আমরা বাজান ছোটখাটো ব্যবসায়ী মানুষ। ওগো লগে পাঙ্গা নিয়া টিকতে পারুম না," বলেন নাসির. উদ্দীন।
"টাকা দিয়াই এদ্দিন ব্যবসা করছি, এহনও করন লাগবো; আমরা এডি মাইনা নিছি," এই বলে কথা শেষ করেন তিনি।
তবে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ অবশ্য চাঁদাবাজির সঙ্গে একই বাজারের ব্যবসায়ী ও যুবদল নেতা আব্দুর রহমানের জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন।
"আম্লীগের নেতারা তো ভাগছে। এরপর হেরাই তো সমিতির অফিস দখল করছে। হেগো সম্মতি ছাড়া কেউ চাঁন্দা নিতে আইবো?," বলছিলেন কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী।
তিনি ঢাকা মহানগর যুবদল উত্তরের সদস্যসচিব সাজ্জাদুল মিরাজের ঘনিষ্ঠ বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
[caption id="attachment_714" align="aligncenter" width="300"]
কারওয়ান বাজারের মাছের আড়ৎ[/caption]
কারওয়ান বাজারের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা ঢাকার গুলিস্তানের।
প্রতিদিন সকাল হতেই গুলিস্তান মোড় ও এর আশপাশের সড়কের ফুটপাত দখল করেন হকাররা। দুপুর গড়াতেই মূল সড়কও দখলে চলে যায় তাদের। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সড়কে যেন তিল ধারণের জায়গা পাওয়া যায় না।
এ অবস্থায় চলাফেরায় ভোগান্তি পোহাতে হয় পথচারী ও গাড়ির চালকদের।
"সরকার চেঞ্জ হয়ে গেলো, কিন্তু গুলিস্তানের কোনো চেঞ্জ নাই। আগেও গাড়ি চলতে পারতো না, এখনও পারে না," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন গাড়ি চালক শরিফুল ইসলাম।
একই কথা বলছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাইফুর রহমান।
"গাড়ি তো দূরের কথা, বিকেলে এখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো অবস্থাও থাকে না," বলেন তিনি।
স্থানীয়রা বলছেন, চাঁদাবাজিই গুলিস্তানের ফুটপাত ও সড়কের এই দুরাবস্থার জন্য দায়ী।
"এইডা এখন আর কোনো রাস্তা নাই। চাঁদাবাজির আখড়ায় পরিণত হইছে। খোঁজ নিয়ে দেখেন হকারদের কে কত টাকা দিয়ে তারপর বসছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন গুলিস্তানের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম আসাদ।
হকারদের সঙ্গে কথা বলে কামরুল ইসলাম আসাদের এই অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বিবিসি বাংলা।
"টাকাছাড়া কেউ এখানে বসতে পারে? আওয়ামী লীগ আমলে যা দিয়া লাগতো এখনও তা-ই দেওয়া লাগে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন হকারদের একজন।
[caption id="attachment_713" align="aligncenter" width="300"]
ট্রাক থেকে পণ্য খালাসের সময়ও চাঁদা দেওয়া লাগে কারওয়ান বাজারে[/caption]
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হকার জানিয়েছেন যে, তিনি পাঁচই অগাস্টের পর ফুটপাতে দোকান বসিয়েছেন। তার কাছে বিবিসি জানতে চেয়েছিল যে, দোকান বাবদ তাকে কত টাকা দিতে হয়েছে? "নগদ একলাখ টাকা গুইনা দিয়া তারপর এখানে বসছি," বলেন ওই হকার।
তবে যারা এককালীন নগদ টাকা দিতে পারেন না, তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে মাসিক কিস্তিতে। আর চাঁদার টাকা দিতে না পারলে দোকান উচ্ছেদ করে সেখানে অন্য লোক বসানো হয় বলে জানিয়েছেন হকাররা।
"আমার ধারে মাসে নয় হাজার টাকা ভাড়া চাইছে। আমি দেতে পারি নাই, পরে আমারে মারধর কইরা দোকান তুইলা দিছে," বলছিলেন মোহাম্মদ রাসেল নামের এক হকার।
তিনি অভিযোগ করেছেন যে, বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরাই এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।
"এর পেছনে আছে বিএনপির গুলিস্তান ইউনিটের শাকিল আর সেলিম। তারাই সবার ধারে টাকা চায়," বলেন মোহাম্মদ রাসেল।
বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করার হুমকি দিলে উল্টো তাকেই মামলায় ফাঁসিয়ে জেল খাটানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন গুলিস্তানের এই হকার।
"প্রতিবাদ করতে গেছি বলে আমারে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাইয়া জেলে ভরছে। প্রায় এক মাস জেলে খাইটা বের হইছি। এখনও হুমকি-ধামকি দেতেছে," বলছিলেন মোহাম্মদ রাসেল।
গুলিস্তানের ফুটপাত ও সড়কে অবৈধভাবে যেসব দোকান বসিয়ে থেকে নিয়মিতভাবে চাঁদা আদায় করা হয়, সেগুলোর সংখ্যা কমপক্ষে তিন হাজার বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
[caption id="attachment_712" align="aligncenter" width="300"]
ঢাকার বেশির ভাগ ফুটপাত হকারদের দখলে[/caption]
চাঁদাবাজির ঘটনায় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের যেসব নেতাকর্মীর নাম সামনে এসেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। যদিও তারা কেউই অভিযোগ স্বীকার করেননি।
এর মধ্যে যুবদল নেতা আব্দুর রহমান দাবি করেছেন যে, চাঁদাবাজির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
"আমি ব্যবসায়ী ফ্যামিলির ছেলে। আমাদের নিজেদেরই দোকান রয়েছে কাওরান বাজারে। আমি কেন চাঁদাবাজি করতে যাবো?," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. রহমান।
পাঁচই অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রায় সারা দেশেই আওয়ামীপন্থীদের স্থান দখল করে বাজার কমিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিএনপিপন্থী ব্যবসায়িক নেতারা।
কারওয়ান বাজারেও সেটার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটনার পর সেখানকার কিচেন মার্কেটেও নতুন করে কমিটি ঘোষণা করা হয়।
সেই কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন আব্দুর রহমান। এছাড়া তিনি যুবদলের তেজগাঁও থানার আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব পদেও ছিলেন। যদিও চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠার পর মি. রহমানকে সম্প্রতি দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
"এ ঘটনায় আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছি। কোনো অপরাধ না করেও আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে," বলেন আব্দুর রহমান।
অপরাধ না করলে দল থেকে বহিষ্কার করা হলো কেন? প্রশ্ন ছিল তার কাছে।
"আসলে গণমাধ্যমের খবরে আমাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার," দাবি করেন আব্দুর রহমান।
এদিকে, আব্দুর রহমান ঢাকা মহানগর যুবদল উত্তরের সদস্যসচিব সাজ্জাদুল মিরাজের ঘনিষ্ঠ বলে সবার কাছে পরিচয় দেন বলে জানিয়েছেন কারওয়ার বাজারের ব্যবসায়ীরা।
বিষয়টি নিয়ে সাজ্জাদুল মিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, "আমার এলাকার নেতা-কর্মীরা সবাই আমার কাছের। দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ করলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।"
[caption id="attachment_711" align="aligncenter" width="300"]
সারা দেশ থেকে সবজি ও মশলা আসে কারওয়ান বাজারের আড়তে[/caption]
তার কিংবা দলের নাম ব্যবহার করে কেউ চাঁদাবাজি করলে তাকে পুলিশে দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন ঢাকা মহানগর যুবদল উত্তরের সদস্যসচিব।
এদিকে, গুলিস্তানে চাঁদাবাজিতে অভিযুক্ত শাকিল এবং সেলিম হকারদের কাছে নিজেদেরকে স্থানীয় বিএনপির নেতা পরিচয় করিয়ে দিলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে, তারা আসলে কর্মী। মোহাম্মদ সেলিম নিজেও সেকথা স্বীকার করেছেন।
"আমি কোনো নেতা না। এমনেই বিএনপির রাজনীতি করি," বলছিলেন মোহাম্মদ সেলিম। চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনিও নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। "আমি এগুলোর মধ্যে নাই," বলেন মোহাম্মদ সেলিম।
গুলিস্তানের হকার মোহাম্মদ রাসেলকে মারধর করে পুলিশে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির এই কর্মী দাবি করেন যে, ছিনতাইয়ের অভিযোগে মারধর করা হয়।
"এ ঘটনার সাথে ব্যবসার সম্পর্ক নাই। ছিনতাইয়ের অভিযোগেই রাসেলরে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে," বলেন মোহাম্মদ সেলিম।
তবে গুলিস্তানের একাধিক হকার জানিয়েছেন যে, চাঁদার টাকা না দেওয়ার কারণেই মোহাম্মদ. রাসেলকে মারধর করা হয়।
[caption id="attachment_710" align="aligncenter" width="300"]
চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায় বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা[/caption]
সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজদের বিষয়ে বিএনপি কঠোর অবস্থানে বলে বলছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। অভিযোগ পেলে সেগুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তারা।
"এমনকি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে আমরা পুলিশের হাতে পর্যন্ত তুলে দিচ্ছি," বলছিলেন বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
পাঁচই অগাস্টের পর দলটির বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও বিষয় নিয়ে একাধিকবার কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করতে দেখা গেছে।
দলীয় নির্দেশনা না মানায় গত সাত মাসে প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এছাড়া চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে দলটির ১২টিরও বেশি কমিটিও ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু তারপরও চাঁদাবাজির মতো ঘটনার সাথে দলটির নেতাকর্মীদের নাম কেন বার বার সামনে আসছে? প্রশ্ন ছিল দলটির সিনিয়র নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের কাছে।
"আসলে বাংলাদেশের কালচারটাই নষ্ট করে দিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ," বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আহমদ।
আওয়ামী লীগের দেখানো পথে বিএনপি নেতাকর্মীরা যেন না হাঁটেন, সেই প্রচেষ্টা চলছে বলে জানান দলটির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের এই নেতা।
[caption id="attachment_709" align="aligncenter" width="300"]
রংপুরে চাঁদাবাজিতে অভিযুক্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ হাসান খন্দকারের নামে মামলা হয়েছে[/caption]
বিএনপি'র বাইরে গত কয়েক মাসে ফেনীতে জামায়াতে ইসলামীর জেলা পর্যায়ের এক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠতে দেখা গেছে।
ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর জাকির হোসেন নামের ওই নেতাকে বহিষ্কার করেছে দলটি। জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে থানায় একটি মামলাও হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বিবিসি'র তরফে জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
এছাড়া গত সাত মা্সে বিভিন্ন স্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধেও চাঁদাজাবির অভিযোগ উঠেছে।
এর মধ্যে চলতি মার্চ মাসের শুরু দিকে রংপুরে নাহিদ হাসান খন্দকার নামে এক নেতার চাঁদা দাবির ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
জেলার হাজির হাট এলাকায় গ্রীন সিটি ইকো পার্ক নির্মাণ প্রকল্পের এক কর্মকর্তার কাছে এক লাখ টাকা দর-কষাকষির ওই ভিডিও সামনে আসার পর অভিযুক্ত হাসান খন্দকারকে পদ থেকে অব্যাহতি দেয় প্ল্যাটফর্মটি।
হাসান খন্দকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অন্যদিকে, ইকোপার্ক কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
দলগুলো বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
তারা বলছেন, পাঁচই অগাস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর শুধু বদল হয়েছে মানুষ, বদলেছে ব্যানার; নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে চাঁদাবাজি। এর থেকে কখনও রেহাই পাওয়া যাবে কি না, এই প্রশ্নের জবাব পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। বিবিসি